শুভ্ৰ হাসি মুখে বলল, আমিতো এ সবের কিছুই জানি না। এক জন লোক হাত ধরে ধরে এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। তারপর থেকে দাঁড়িয়েই আছি।
জরী বলল, চলুন হাত ধরে ধরে আপনাকে চার নম্বর প্ল্যাটফরমে নিয়ে যাই। ধরুন হাত ধরুন। সংকোচ করার কিছু নেই। আপনি হচ্ছেন কানা বাবা।
জরী ভেবে পেল না সে হঠাৎ এত কথা বলছে কেন? সে তো চুপচাপ ধরনের মেয়ে। এত কথাতো সে কখনো বলে না। আজ তার হয়েছেটা কি?
শুভ্ৰ হাত ধরল। খানিকটা ইতস্ততঃ করে বলল, আপনিই বা কেন এদিকে এলেন? আপনারাওতো চার নম্বর প্ল্যাটফরমে থাকার কথা।
কেউ এখনো আসে নি। তাই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আচ্ছা আপনার চোখ এত খারাপ আপনারতো উচিত বাড়তি চশমা রাখা।
শুভ্র বলল, এক্সট্রা চশমা বাড়িতে আছে।
জরী বলল, আপনার ব্যাগ কে গুছিয়ে দিয়েছে বলুনতো?
আমার মা।
তাহলে ব্যাগ খুললেই বাড়তি চশমা পাওয়া যাবে। দেখি আপনার ব্যাগটা খুলি। চাবি দিনতো।
শুভ্র বলল, আমার মনে হয় না। মা বাড়তি চশমা দিয়েছেন।
অবশ্যই দিয়েছেন। কোনো মা এত বড় ভুল করবে না। দিন চাবি দিন।
ব্যাগ খুলতেই খাপে মোড়া দুটা চশমা পাওয়া গেল।
চোখে চশমা দিয়ে শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি এত সেজেছেন কেন? আজ রাতে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। এটা হচ্ছে বিয়ের সাজ। বিয়ে হয়নি বলেই যেতে পারছি।
শুভ্র বলল, ভাগ্যিস হয় নি। বিয়ে হলে আপনার সঙ্গে দেখা হত না। আমারো দারুচিনি দ্বীপে যাওয়া হত না। বোকার মতো একা একা ভুল প্ল্যাটফরমে দীড়িয়ে থাকতাম। কেউ আমাকে খুঁজে পেত না। আর পেলেও কেউ বুদ্ধি করে বলতে পারত না যে আমার ব্যাগে এক্সট্রা চশমা আছে। আমাকে যেতে হত। অন্ধের মতো।
জরী হাসল।
এখন তার সব কিছুই ভালো লাগছে। পৃথিবীটা অনেক বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে। ন্টেশনের হৈচৈ আলো সব মিলিয়ে কেমন যেন নেশা ধরে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে পৃথিবী এত সুন্দর কেন? আরেকটু কম সুন্দর হলে তো ক্ষতি ছিল না। দুই জন হাঁটছে ছোট ছোট পা ফেলে। শুভ্ৰ হঠাৎ কি মনে করে বলে ফেলল, চশমাটা পাওয়া না গেলেই ভালো হত।
কেন?
আপনি আমাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যেতেন। আপনি যখন আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন আমার অসম্ভব ভালো লাগছিল। কিছু মনে করবেন না- কথাটা বলে ফেললাম। বেশির ভাগ সময় আমরা মনের কথা বলতে পারি না বলে কষ্ট পাই। আমি ঠিক করেছি। আমি এই ভুল কখনো করব না। যা বলতে ইচ্ছা করে— তা বলব। আপনি কি রাগ করলেন?
জরী সহজ গলায় বলল, না রাগ করি নি। আপনি বরং এক কাজ করুন চশমাটা খুলে পকেটে রেখে দিন। আমি আপনাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাই। নয়ত ওরা দেখলে হাসাহসি করবে।
শুভ্র চশমা খুলে পকেটে রাখল।
জরী তাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দলটির সঙ্গে দেখা হলো। সবাই একসঙ্গে চেচিয়ে উঠল— কানা বাবা। কানা বাবা।
আনুশকা ছুটে এসে বলল, জরী তোরতো যাওয়ার কথা ছিল না।
জরী বলল, চলে এলাম।
খুব ভালো করেছিস। খুব ভালো। তুই কানা বাবাকে কোথায় পেলি?
পেয়ে গেলাম। বেচারা চশমা ভেঙ্গে ফেলেছে। হাত ধরে আনা ছাড়া উপায় কি?
দলের সবাই আবার চেঁচিয়ে উঠল— কানা বাবা। কানা বাবা।
সঞ্জুর বাবাও এসেছেন।
সঙ্গে মুনাকে নিয়ে এসেছেন। সঞ্জু খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
সে বুঝতে পারছে তাকে নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে গা টেপাটেপি হচ্ছে। মোতালেব ফিস ফিস করে বলল, দেখ সবাই দেখা খোকাবাবুর বাবা ফিডিং বোতল হাতে চলে এসেছে। লোকটার কি বুদ্ধি শুদ্ধি নেই?
সবাই ট্রেনে উঠেছে। প্রথম শ্রেণীর রিজার্ভ করা কামরায় নয়। থার্ড ক্লাসে। তাতে কারোর আনন্দে ভাটা পড়ছে না। হাসাহাসি, আনন্দ উল্লাসের সীমা নেই। আনুশকা পাশের অচেনা এক ভদ্রলোককে বলল, ব্রাদার আপনি কি সেন্ট মেখেছেন গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে। সেই লোক হতভম্ব।
জরী শুভ্ৰকে বলল, আপনি চশমা পরছেন না কেন?
শুভ্ৰ হাসিমুখে বলল, আমি চশমা পরব না বলে ঠিক করেছি।
বেশ তাহলে হাত ধরুন। আপনাকে ট্রেনে নিয়ে তুলি।
মোতালেব চেঁচিয়ে বলল, ভাইসব রাস্তা করে দিন, কানা বাবা আসছে কানা বাবা। দি লারনেড ব্লাইন্ড ফাদার।
নীরা চেঁচিয়ে বলল, অবিকল এই রকম একটা দৃশ্য আমার কল্পনায় ছিল। সুনীল অন্ধ হয়ে গেছে। আমি তার হাত ধরে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সুনীল এই পৃথিবীকে দেখছে আমার চোখ দিয়ে। বানিয়ে বলছি না। বিশ্বাস করা। এই দ্যাখ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
আনুশকা বলল, লারনেড ব্লাইন্ড ফাদারকে সারাক্ষণ হাত ধরে ধরে কে টানবে? চিটাগাং নেমেই ওর জন্যে চশমার ব্যবস্থা করতে হবে। শুনুন লারনেড ব্লাইন্ড ফাদার, সব সময় আমরা আপনাকে আপনি বলেছি, এখন আর বলব না। দয়া করে কিছু মনে করবেন না।
শুভ্ৰ হাসল। মাথা ঝাকিয়ে বলল, আমি খুব খুশি হব। যদি তা করেন।
আরেকটা কথা এমন ফরম্যাল ভঙ্গিতে কথা বলবেন না, বললে চিমটি খাবেন।
জ্বি আচ্ছা। আর বলব না।
রানা বলল, একটা গান ধরলে কেমন হয়?
নীরা বলল, খুব খারাপ হয়। আচ্ছা আমি বসব কোথায়? আমার তো বসার জায়গা নেই।
রানা বলল, তুমি এবং সুনীল তোমরা দুই জন দাঁড়িয়ে যাও। হাত ধরা ধরি করে দাঁড়িয়ে থাক।
আমার দাঁড়িয়ে যেতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সুনীলকে বসতে দাও। জানালার পাশে বসতে দাও। বেচারা কবি মানুষ।
সত্যি সত্যি জানালার পাশে খানিকটা জায়গা খালি করা হলো। সেখানে কেউ বসল না।
মুনা লক্ষ্য করল। সবাই আছে শুধু অয়ন নেই।