জরীর মা ক্ষীণ গলায় বললেন, এখন কি করা?
ইউসুফ সাহেব বললেন, এইটা নিয়েই চিন্তা করছি। মুনিরের বাবার সঙ্গে কথা হলো।
জরী বলল, কি কথা হলো?
তোমার তা শোনার দরকার নেই। তুমি ঘরে যাও।
জরী উঠে চলে গেল। ইউসুফ সাহেব বললেন, মুনিরের বাবা বলেছেন তারা কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিতে চান। দেরী করতে চান না, কারণ ছেলে খুব মন খারাপ করেছে।
জরীর মা বললেন, বিয়ের পর ওরা আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিবে।
কষ্ট দিবে কি জন্যে? বিয়ে হয়ে গেলে সব সমস্যার সমাধান। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে কেউ কিছু মনে রাখবে না।
বিয়ে কখন হবে?
ওরা পঞ্জিকা টঞ্জিকা দেখছে। যদি দিন শুভ হয় আজ রাতেও হতে পারে।
এইসব কি বলছেন ভাইজান।
চিন্তা ভাবনা করেই বলছি। চিন্তা ভাবনা ছাড়া কাজ করা আমার স্বভাব না।
জরী যে কাণ্ড করেছে তারপর এ ছাড়া অন্য পথ নেই।
মেয়েটার মত নাই।
বাজে কথা বলবে না। মত নাই আগে বলল না কেন? এনগেজমেন্টের আগে বলতে পারল না? জরীকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ওদের টেলিফোন আগে পাই ওরা যদি আজ রাতে বিয়ের কথা বলে তখন আমি জরীকে বুঝিয়ে বলব।
জরীর মা ক্ষীণ গলায় বললেন, আরো কয়েকটা দিন সময় দিলে মেয়েটা ঠাণ্ডা হত।
আমার মতে আর এক মুহুর্ত সময়ও দেয়া উচিত না। সময় দিলে ক্ষতি। বিরাট ক্ষতি। ওদের কিছু না, ক্ষতি আমাদের… ।
ইউসুফ সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই টেলিফোন এল। মুনিরুদিনের বাবা টেলিফোন করেছেন। সবার সাথে কথা টথা বলে ঠিক করেছেন-বিয়ে আজ রাতেই পড়ানো হবে। রাত দশটার মধ্যে বিয়ে পড়ানো হবে। এগারটার দিকে তারা বৌ নিয়ে চলে যাবেন। সামনের সপ্তাহে হোটেল সোনারগাঁয়ে রিসিপশন।
ইউসুফ সাহেব জরীর মাকে বললেন, তুমি তোমার গুণবতী মেয়েকে আমার কাছে পাঠাও।
ভাইজান একটা বিষয় যদি বিবেচনা করেন।
সব দিক বিবেচনা করা হয়েছে। বিবেচনার আর কিছু বাকি নেই।
মেঘবতী
মনসুর আলি সাহেব বাগানে গোলাপ গাছের কাছে খুপড়ি হাতে বসেছিলেন। পাঁচটি গোলাপ এই গাছটায় একসঙ্গে ফুটেছে। টকটকে লাল গোলাপ। মনে হচ্ছে গাছে যেন আগুন লেগে গেছে। গাছটা যেন আনন্দ, গর্ব এবং অহংকারের সঙ্গে উঁচু গলায় বলছে দেখ তোমরা আমাকে দেখ।
এ রকম একটা গাছের একটু যত্ন নিজের হাতে না করলে ভালো লাগে না। মনসুর সাহেব মাটি আলগা করে দিচ্ছেন। মাটির ফাঁকে ফাঁকে যেন গাছের জীবনদায়িনী নাইট্রোজেন প্রচুর পরিমাণে যেতে পারে।
মেঘবতী এগিয়ে এল। খুব ধীর পায়ে আসছে। বেচারীর শরীর ভালো না। কাল রাতে সে কিছুই খায় নি। খাবার খানিকক্ষণ ওঁকে নিজের জায়গায় চলে এসেছে। দুটি থাবার মাঝখানে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তিনি মেঘবতীর দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললেন, আয় আয়। দেখা ফুলের বাহার দেখি।
মেঘবতী কাছে এসে তাঁর পাঞ্জাবীর এক কোণ কামড়ে ধরে চুপ করে বসে রইল। তিনি মাটি কুপিয়ে দিতে লাগলেন। বড় ভালো লাগছে। শীতের সকালের এই চমৎকার রোদ, ফুলের গন্ধ, গা ঘেষে বসে থাকা প্রিয় প্রাণী। এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের যোগফল বিরাট একটি সংখ্যা। সেই সংখ্যা অসীমের কাছাকাছি।
মনসুর সাহেব খুড়পি নামিয়ে পাঞ্জাবীর পকেটে চুরুটের জন্যে হাত দিলেন।
মেঘবতী পাঞ্জাবীর পকেট এখনো কামড়ে ধরে আছে।
মেঘবতী, ছাড়তো দেখি, চুরুট নেব।
মেঘবতী ছাড়ল না।
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। কিছুক্ষণ তাঁর চোখে পলক পড়ল না। মেঘবতী মরে পড়ে আছে। মৃত্যুর আগে আগে সে কিছু একটা বলতে এসেছিল। বলতে পারে নি। পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর তার হৃদয়ে ভালোবাসা দিয়েছিলেন, মুখে ভাষা দেন নি। মৃত্যুর আগে আগে যে কথাটি সে বলতে এসেছিল তা বলতে পারে নি। সে তার প্রভুর পাঞ্জাবীর পকেট কামড়ে ধরে অচেনা অজানার দিকে যাত্রা করেছে।
মনসুর সাহেব ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন, আনুশকা। আনুশকা। আনুশকাকে ডাকতে গিয়ে তার গলা ভেঙ্গে গেল।
আনুশকা ছুটে এলা। মনসুর সাহেব ভাঙ্গা গলায় বললেন, তোমার মেঘবতীর গায়ে একটু হাত রাখ মা।
আনুশকা কয়েক পলক মেঘবতীর দিকে তাকিয়ে ছুটে গেল নিজের ঘরের দিকে।
এই বিশাল বাড়িতে সে ছিল নিঃসঙ্গ। মেঘবতী তাকে সঙ্গ দিয়েছে। কত রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে ভয় পেয়ে ডেকেছে, মেঘবতী।
ওম্নি জানালার কাছে মেঘবতীর গর্জন শোনা গেছে। সে জানিয়ে গেছে— আছি আমি আছি। তোমার মা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, তোমার বাবা ঘুরছেন জাহাজে জাহাজে, কিন্তু আমি আছি। আমি আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকব। আমি পশু, আমি মানুষের মতো প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়া শিখি নি।
আনুশকা ফুলে ফুলে কাঁদছে।
মনসুর সাহেব আনুশকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
মা এমন করে কাঁদলে চলবে? রাত নটা বাজে। আজ না তোমাদের দারুচিনি দ্বীপে যাবার কথা।
আমি কোথাও যাব না।
তাতো হয় না মা। তুমি না গেলে তোমার বান্ধবীরা যাবে না। তোমার একার কষ্টের জন্যে তুমি অন্যদের কষ্ট দিতে পার না। সেই অধিকার তোমার নেই মা?
বললামতো আমি যাব না।
তুমি মানুষ হয়ে জন্মেছ মা। মানুষ। শুধু একার জন্যে বাঁচে না— মানুষ অন্যদের জন্যেও বাঁচে। এইখানেই মানুষ হয়ে জন্মানোর আনন্দ। এইখানেই মানুষ হয়ে জন্মানোর দুঃখ। মা উঠ। তোমার বান্ধবীরা সব মুখ কালো করে বসে আছে।
আনুশকা নড়ল না।
মনসুর সাহেব বললেন, তোমার মা যেদিন হঠাৎ করে এলে আমাকে বলল, আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে পারছি না। আমি চলে যাচ্ছি। সেদিনও আমি কিন্তু ঠিক সময়ে অফিসে গিয়েছি। মা, তুমিতো আমার মেয়ে। আমার মেয়ে না?