মনিরুদ্দিন তার ডান হাত জরীর হাটুর উপর রেখেছে। গানের তালে তালে সেই হাতে তাল দিচ্ছে।
পরশু দিন রাতে কোথায় ছিলেন?
আমার এক বন্ধুর বাসায়।
উচিত না।
উচিত না কেন?
বন্ধু বান্ধব থাকা ভালো। গল্প গুজব করাও ভালো। তাই বলে রাতে থেকে যাওয়া ঠিক না।
জরী প্রাণপণ চেষ্টা করছে পাশে বসে থাকা মানুষটিকে ভুলে গিয়ে গানে মন দিতে। যেন গানটিই সত্যি। আশে পাশের জগৎ সত্যি নয়। অরুন্ধতী হোম চৌধুরী কি অপূর্ব গলা।
মুখ পানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে–
ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে।
মনিরুদ্দিন একটি হাত জরীর কাঁধে তুলে দিয়েছে। পায়ের উপর থেকে সেই হাত কাঁধে উঠে এসেছে। জরী খুব চেষ্টা করছে নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে। যা হবার হোক।
মনিরুদিন অস্পষ্ট স্বরে বলল, একটু এদিকে সরে বস তাহলেই ড্রাইভার ব্যাকভিউ মিররে কিছু দেখবে না। এ রকম শক্ত হয়ে আছ কেন?
মনিরুদ্দিন জরীর বুক স্পর্শ করল।
জারী শিউরে উঠল।
মনিরুদ্দিন অভয়ের হাসি হেসে বলল, গাড়ির কাঁচ টিনটেড। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না।
জরী চেঁচিয়ে বলল, ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামান। আমি নামব। থামান বলছি। এক্ষুণি থামান। এক্ষুণি।
ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামাল।
আপনি একটি কথাও বলবেন না। আমি এই খানে নেমে যাব। আপনি যদি বাধা দিতে চেষ্টা করেন। আমি চিৎকার করে লোক জড় করব।
তুমি, তুমি যাচ্ছ কোথায়?
আমি দারুচিনি দ্বীপে যাব।
কি বলছি তুমি? দারুচিনি দ্বীপ কি?
আপনি বুঝবেন না।
জরী গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল।
জরী সন্ধার পর বাসায় ফিরল। জরীর মা সম্ভবত সারাক্ষণই গেটের দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি ছুটে এসে মেয়ের হাত ধরে ভীত গলায় বললেন, কি হয়েছেরে মা, কি হয়েছে?
জরী সহজ গলায় বলল, কিছু হয়নিতো।
জামাই তোর বড় চাচাকে টেলিফোন করেছিল। তুই নাকি রাগারাগি করে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেছিস। জামাইকে খারাপ খারাপ কথা বলেছিস। অপমান করেছিস। জামাই অসম্ভব রাগ করেছে।
রাগ করলে কি আর করা।
তোর চাচাও রাগ করছে। খুবই রাগ করেছে। বসে আছে তোর জন্যে।
জরী বলল, মা তোমার কাছে টাকা আছে? আমাকে দেবে। আমি পালিয়ে যাব মা।
কি বলছিস পাগলের মতো? আয় ভেতরে আয়। কি হয়েছে বলতো। চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেলি কেন? যদি এ্যাকসিডেন্ট হত?
চলন্ত গাড়ি থেকে নামি নি।
হয়েছিল কি?
কিছু হয় নি।
তোর বাবা টেলিফোন আসার পর থেকে ছটফট করছেন। তাঁর অসুখ খুব বেড়েছে। আয় প্রথমে তোর বাবার কাছে আয়।
জরীর বাবা হাঁপানির প্রবল আক্রমণে নীল বর্ণ হয়ে গেছেন। বিছানায় পড়ে আছেন চোখ বন্ধ করে। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টায় তাঁর বুক উঠা নামা করছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। জরীর ছোট বোন বাবার মাথার কাছে মুখ কাল করে বসে আছে। জরী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল— এত কষ্ট, এত কষ্ট। এত কষ্টের কোনো মানে হয়? কোন অর্থ হয়?
জরীর বাবা একবার চোখ তুলে তাকালেন। পরমুহুর্তেই চোখ বন্ধ করে আগের মতোই ছটফট করতে লাগলেন। জরীর মা ফিস ফিস করে বললেন জামাই-এর টেলিফোনের খবর শোনার পর শ্বাস কষ্ট শুরু হলো।
জরী এই ঘরে আর থাকতে পারছে না। এই কষ্ট দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। সে এগিয়ে এসে বাবার মাথায় হাত রাখল। তিনি চোখ মেললেন এবং জরীকে অবাক করে দিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। যেন মেয়েকে দেখে খুশি হয়েছেন।
জরী বলল, বাবা আমি ভালো আছি।
তিনি মাথা নাড়লেন।
মনে হচ্ছে তার কষ্ট খানিকটা কমে এসেছে। বুক আগের মতো উঠা নামা করছে না। ওষুধ দেয়া হয়েছিল সেই ওষুধ হয়ত বা কাজ করতে শুরু করেছে। শ্বাসনালীর প্রদাহ কমার দিকে। জরী আবার বলল, বাবা আমি ভালো আছি।
তিনি ইশারা করে সবাইকে চলে যেতে বললেন, এর অর্থ তার কষ্ট এখন সত্যি সত্যি কমার দিকে। কষ্টটা কমলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। সম্ভবত তার ঘুম আসছে। সবাই ঘর খালি করে বের হয়ে এল।
জরীর বড় চাচা ইউসুফ সাহেব বসে আছেন থমথমে মুখে।
তার সামনেই জরীর মা এবং জরী।
কথাবার্তা এখনো শুরু হয় নি। ইউসুফ সাহেব চা খাচ্ছেন। কি বলবেন এবং কি ভাবে বলবেন তা হয়ত ঠিক করছেন। মেয়েটার শান্ত মুখের দিকে যতবার তাকাচ্ছেন ততবারই তাঁর রাগ উঠে যাচ্ছে। এতবড় ঘটনার পর মেয়েটা এ রকম শান্ত মুখে বসে আছে কি করে? সে ভাবে কি নিজেকে?
তিনি কিছু বলার আগেই জয়ী বলল, চাচা আমি ঐ লোকটাকে বিয়ে করব না।
ইউসুফ সাহেব জরীর সাহস ও স্পর্ধা দেখে চমকে গেলেন। তিনি রাগ সামলে নীচু গলায় বললেন, বিয়ে করবে, কি করবে না। এই কথা আমি জিজ্ঞেস করি নি। আগ বাড়িয়ে কথা বলছ কেন? কি ভাব নিজেকে? আমি যা জিজ্ঞেস করি তার জবাব দেবে। কি হয়েছিল যে তুমি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামলে?
জয়ী চুপ করে রইল।
তুমি যে ছেলেটাকে অপমান করলে তুমি এদের ক্ষমতা জান? এদের অর্থ বিত্তের খবর রাখ? সে কি করেছে যে তাকে গালাগালি করে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামবে। চিৎকার করে লোক জড় করবো?
আমি চিৎকার করে লোক জড় করি নি।
তুমি বলতে চাও সে মিথ্যা কথা বলছে? কথা বলছ না কেন? না-কি বলার মতো কথা পাচ্ছ না?
ইউসুফ সাহেব জরীকে তুই করে বলেন, আজ তুমি বলছেন। এতে রাগ প্রকাশ পাচ্ছে এবং দূরত্বও প্রকাশ পাচ্ছে।
শোন জরী, মনির সব কথাই আমাকে বলেছে। কিছুই গোপন করে নি।
কি বলেছে?
তোমার সঙ্গে এই নিয়ে ডিসকাস করা উচিত না। তবু তুমি যখন শুনতে চোচ্ছ তখন বলছি- সে তার ভাবি স্ত্রীর হাত ধরেছে— এটা এমন কি অপরাধ? আমি যতদূর জানি তোমরা ক্লাসের ছেলের হাত ধরাধরি করে হাঁট। তখন অপরাধ হয় না? তারা কি পরিমাণ রাগ করেছে তা-কি তুমি জান? মুনির টেলিফোনে কাঁদছিল। মুনিরের বাবা টেলিফোন করেছেন, মুনিরের এক মামা পুলিশের এ আই জি উনি টেলিফোন করেছেন। জিয়ার আমলে পাটমন্ত্রী ছিলেন যে ভদ্রলোক উনিও টেলিফোন করেছেন।