এই রোবট-মানব কোনোদিন বৃষ্টিতে ভেজেন না।
বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলেই তাঁর টনসিল ফুলে যায়। জোছনা রাতে কখনো ছাদে যান না। ছাদে উথালপাথাল বাতাস। সেই উথালপাথাল বাতাস গায়ে লাগলেই তার মাথা ধরে।
মানুষটাকে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন বলা যেতে পারে। শেষ গন্তব্যের একটা স্টেশনে সে যাত্রা শুরু করেছে। মাঝ পথে কত না সুন্দর সুন্দর স্টেশন। ট্রেন সেখানে থামছে না। ঝড়ের গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে। গন্তব্যের দিকে যতই যাচ্ছে ততই তার গতিবেগ বাড়ছে। আজকাল রেহানার প্রায়ই ইচ্ছা করে কোনো একটা গ্রামের স্টেশন, সিগন্যাল ডাউন করে রেড লাইট জ্বলিয়ে ট্রেনটাকে থামিয়ে দিক। গন্তব্যে যে পৌছতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।
শুভ্ৰ বাবা, এই নাও তোমার চশমা।
থ্যাংকস মা।
কাল রাতেও তুমি বাতি জ্বলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ।
শুভ্ৰ মিটি মিটি হাসল।
কাল রাত কটা পর্যন্ত জেগেছ?
ঘড়ি দেখিনি মা। রাত দুইটা কিংবা তিনটা হবে।
এমন কি পড়ছিলে যে রাত শেষ করে দিতে হবে?
খুব ইন্টারেস্টিং বই… শেষ না করে ঘুমুতে ইচ্ছা করছিল না।
ফিজিক্সের কোন বই?
উহুঁ। লাভ ক্টোরি।
এসো নাসতা খেতে এসো।
নাশতার টেবিলটা তিন জনের জন্যে বিশাল। ছোট আরেকটা টেবিল আছে, ইয়াজউদ্দিন সাহেবের সেই টেবিলটা পছন্দ নয়। দিনের মধ্যে একবারই তিনি শুধু সবার সঙ্গে বসেন—সেটা সকালের নাশতার সময়। বিশাল টেবিলের এক প্রান্তে তাঁর নির্দিষ্ট বসার চেয়ার আছে। মা এবং ছেলে বসে মুখোমুখি। ইয়াজউদ্দিন সাহেব নাশতা খেতে খেতে গল্প করেন। অল্প খানিকক্ষণ সময়ের জন্যে মনে হয়— মানুষটা বোধ হয় রোবট নয়।
ইয়াজউদ্দিন সাহেবের প্রিয় খাবার এক বাটি মটরশুটি সিদ্ধ করে তাঁর সামনে দেয়া হয়েছে। খোসা ছাড়িয়ে তিনি মটরশুটি খাচ্ছেন। তার ঠিক সামনে টি-পটে এক পট চা, মোট তিন কাপ চা আছে। নাশতার টেবিলে তিনি আড়াই কাপের মতো খাবেন। তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, শুভ্ৰ তোমার কি খবর?
শুভ্ৰ হাসল, কিছু বলল না।
তিনি রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, রেহানা শুভ্রকে আজ প্রিন্সের মতো লাগছে না?
রেহানা বললেন, লাগছে। তবে…
আবার তবে কি? তোমার কি কোনো সন্দেহ আছে?
না।
তা হলে তবে বললে কেন?
তুমি তো আমাকে কথা শেষ করতে দাও নি। কথা শেষ করতে দিলে তবে কেন বলেছি তা এক্সপ্লেইন করতাম।
সরি, কথা শেষ কর…
তবে বলেছি কারণ শুভ্রর সবচে সুন্দর জিনিস তার চোখ। চশমার জন্যে তার চোখ কখনো দেখা যায় না। Its a pity.
শুভ্র বলল, মা চুপ করতো। এই টপিকটা আমার কখনো ভালো লাগে না।
ইয়াজউদ্দিন বললেন, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচে বড় সমস্যা কি জান শুভ্র? যে টপিকটি সে পছন্দ করে না তাকেই সেই টপিকটি সবচে বেশি শুনতে হয়। আমার কথাই ধর—পলিটিক্সে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমাকে সারাক্ষণ সেই পলিটিক্সের কথা শুনতে হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শিল্পমন্ত্রী কিংবা পাটিমন্ত্রী এই জাতীয় কোন দপ্তর আমাকে নিতে হতে পারে। রেহানা কি বলছি, শুনছ?
শুনছি।
এই বিষয়ে তোমার কোনো মতামত আছে?
না।
তুমি কি চাও যে আমি পলিটিক্সে ইনভল্ভ্ড হই?
তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না।
এ রকম উঁচুগলায় কথা বলছি কেন? আমি চাই চায়ের টেবিলে সব সময় লাইভলি ডিসকাশন হবে।
তোমার চাওয়া মত পৃথিবী চলবে এটাই বা ভাবছ কেন? আমার চাওয়ারও তো কিছু থাকতে পারে?
একটু আগে বলেছ। আমার কাছে তোমার কিছু চাওয়ার নেই। তুমি কি নিজেকেই নিজে কনট্রাডিক্ট করছ না?
রেহানা কিছু বললেন না।
ইয়াজউদ্দিন দ্বিতীয় কাপ চা ঢালতে ঢালতে বললেন, রেহানা আমার সঙ্গে তর্ক করতে এসো না। তর্কে হারবে, মন খারাপ করবে। তর্কে হেরে যাওয়া খুবই অপমানজনক ব্যাপার।
রেহানা টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।
ইয়াজউদ্দিন শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার মাকে তোমার কাছে কেমন লাগে শুভ্র?
ভালো।
আরো গুছিয়ে বল। সাধারণ একটা এডজেকটিভ দিয়ে তো কিছু বোঝা যায় না। একশ নম্বর যদি থাকে তা হলে তুমি তোমার মাকে কত দেবে?
বিরানব্বুই থেকে তিরানব্বুই দেব।
আমাকে কত দেবে?
বললে তোমার হয়ত মন খারাপ হবে।
এত সহজে আমার মন খারাপ হয় না।
তোমাকে আমি দেব পঁয়তাল্লিশ।।
তোমার ধারণা তোমার জাজমেন্ট ঠিক আছে?
হ্যাঁ।
শুভ্র এত কম নাম্বার আমি কিন্তু ডিজাৰ্ভ করি না।
তুমি মন খারাপ করেছ বাবা। একটু আগে বলেছ। তুমি মন খারাপ কর না।
মন খারাপ করি না এমন কথা বলিনি। বলেছি—এত সহজে মন খারাপ করি না। তুমি যে কথা বলছি তা সহজ না। এখন তুমি বুঝতে পারছি না। যে দিন বাবা হবে এবং যে দিন তোমার মুখের উপর তোমার ছেলে তোমাকে ফর্টি ফাইভ নাম্বার দেবে সেদিন বুঝবে।
বাবা, আমি তোমাকে হার্ট করেছি। আই এ্যাম সরি।
ইয়াজউদ্দিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি যতটা হার্ট হয়েছি বলে দেখাচ্ছি ততটা হইনি। কারণ আমি জানি তুমি আমাকে ঠিকমতো জাজ কর নি।
আমার জাজমেন্টে তেমন কিছু যায় আসে না।
তা-ও সত্যি। তুমি এখনো এক জন বালক। তোমার বয়স বাইশ হয়েছে আমি জানি–কিন্তু এখনো বালক স্বভাব ত্যাগ করতে পার নি। আশে-পাশের জগৎ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। তোমার জগৎ হচ্ছে তোমার শোবার ঘর, তোমার পড়ার ঘর এবং এই বাড়ি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
শুভ্র তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ভারী কাচের আড়ালে তার চোখ। কাজেই শুভ্ৰ কি ভাবছে বা কি ভাবছে না কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে ভয় পাচ্ছে না-খানিকটা মজা লাগছে। বাবাকে এর আগে সে কখনো এমন রেগে যেতে দেখে নি।