তোর বাবা আমাকে কুত্তী বলে গাল দিয়েছে।
চুপ কর মা, ছিঃ। গাল দিলেও কি নিজের মেয়ের কাছে বলতে আছে?
তোকে না বললে কাকে বলব?
অনেক কথা আছে কাউকেই বলতে হয় না। আমি কি আমার সব কথা তোমাকে বলি? কখনো বলি না। কোনদিন বলবাও না।
এটা খুবই সত্যি কথা জরী তার নিজের কথা কাউকেই বলে না। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এমন এক জন কেউ যদি থাকতো যাকে সব কথা বলা যায়।
রোদে বসে জরী তাই ভাবছিল। তার হাতে একটা ম্যাগাজিন। মাঝে মাঝে সে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে, তবে সে কিছু দেখছেও না পড়ছেও না। হাতে একটা ম্যাগাজিন থাকার অনেক সুবিধা, কেউ এলে ম্যাগাজিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া যাবে। কথাবার্তায় যোগ দিতে হবে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে—এখন একটা মজার জিনিস পড়ছি। পরে কথা বলব।
জরীর মা মনোয়ারা দোতলায় উঠে এলেন। খানিকটা উত্তেজিত গলায় বললেন, জামাই এসেছে। জামাই।
জরী ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে লাগল। যেন সে কিছু শুনতে পায় নি।
জামাই এসেছে। নিচে বসে আছে।
জরী শীতল গলায় বলল, জামাই বলছি কেন মা? বিয়ে এখনো হয় নি। বিয়ে হোক তারপর বলবে।
তুই শাড়িটা বদলে নিচে যা।
কেন?
তোকে নিয়ে বাইরে কোথায় যেন খেতে যাবে বলছে।
জরী তাকিয়ে রইল। তার খুব রাগ লাগছে। যদিও রাগ করার তেমন কোনো কারণ নেই। এক মাস পর যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে যদি তাকে নিয়ে এক দুপুরে বাইরে খেতে যেতে চায় তাতে দোষ ধরার কিছু নেই। এটাই তো স্বাভাবিক।
মনোয়ারা বললেন, জামাই পরশু রাতেও এসেছিল। তুই তোর কোন এক বন্ধুর বাসায় ছিলি। শুনে খুব রাগ করল।
জরী বলল, রাগ করল মানে?
না। রাগ না ঠিক ঐ বলছিল আর কি—এই বয়েসী মেয়েদের বন্ধুবান্ধবদের বাসায় রাত কাটানো ঠিক না।
তুমি কি বললে?
আমি কি বলব? আমার সঙ্গেতো কথা হয়নি তোর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে।
বাবাকে সে উপদেশ দিল?
তুই সবার কথার এমন প্যাঁচ ধরিস কেন? উপদেশ না। কথার কথা বলেছে। আয় মা চট করে শাড়িটা বদলে আয়।
আমি যেতে পারব না।
এটা কেমন কথা।
যেতে ইচ্ছা করছে না মা।
তোর বড় চাচা নিচে বসে আছেন। উনি শুনলে রাগ করবেন।
জরী উঠে দাঁড়াল। মনোয়ারা বললেন, আয় আমি চুলটা আঁচড়ে দেই। তুই শাড়িটা বদলা।। গোলাপী জামাদানীটা পর। তোর চাচীর মুক্তার দুল জোড়া পরবি? নিয়ে আসব?
নিয়ে এসো।
মনোয়ারা ছুটে গেলেন। মেয়েকে অতি দ্রুত সাজিয়ে দিতে হবে নয়ত জরীর বড় চাচা রাগ করবেন। যার আশ্রয়ে বাস করছেন তাঁকে রাগানো ঠিক হবে না। কিছুতেই ঠিক হবে না। আজ যদি তিনি বলেন, অনেক দিনতো হলো এখন তোমরা নিজেরা একটা ব্যবস্থা দেখ। তখন কি হবে? কোথায় যাবেন তিনি? অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কার ঘরে উঠবেন?
জরী বেশ যত্ন করে সাজল। কানো দুল পরল। চোখে হালকা করে কাজল দিল। তার চোখ এম্নিতেও সুন্দর, কাজল দেয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই। তবু কাজল দিলেই চোখে একটা হরিণ হরিণ ভাব চলে আসে। অবশ্যি সে জানে বসার ঘরের সোফায় বসে অতি দ্রুত যে লোকটি পা নাড়াচ্ছে সে ভুলেও তার চোখের দিকে তাকবে না। পৃথিবীতে দুই ধরনের পুরুষ আছে। এক ধরনের পুরুষ তাকায় মেয়েদের দিকে। চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে। অন্য দল তাকায় শরীরের দিকে।
মনিরুদ্দিন আজ থ্রী পিস সুট পরে এসেছে। গা দিয়ে ভুর ভুর করে সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। সেই গন্ধের সঙ্গে মিশেছে। জর্দার কড়া গন্ধ। তার মুখ ভর্তি পান। পানের লাল রসের খানিকটা ঠোঁটের উপর জমা হয়ে আছে। সে অতি দ্রুত পা নাড়াচ্ছে। জরীকে ঢুকতে দেখে সে তাকাল। সেই দৃষ্টি কয়েকবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নড়াচড়া করল। জরীর চাচা বলল, বস মা।
মনিরুদ্দিন বলল, চাচাজানের সঙ্গে দেশের অবস্থা নিয়ে কথা বলছিলাম। এই দেশে ভদ্রলোকের ব্যবসা করা সম্ভব না। যারা জেনুইন ব্যবসা করে তাদের জন্যে এই দেশ না। দালালদের জন্যে এই দেশ।
জরীর চাচা বললেন, খুবই সত্য কথা।
মনিরুদ্দিন বলল, কি আছে। এই দেশে বলেন দেখি চাচাজান। সামান্য অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসার জন্যে যেতে হয় ব্যাংকক। চিকিৎসা বলে এক জিনিস এই দেশে নাই।
ঠিক বলেছ।
তারপর ধরেন এড়ুকেশন। এড়ুকেশনের ‘এ’টাও এদেশে নাই।
জরী মনে মনে বলল, এড়ুকেশনের ‘ই’। ‘এ’ নয়।
পলিটিকসের কথা যদি ধরেন চাচাজান তাহলে বলার কিছুই নাই।
খুবই সত্যি কথা।
বুঝলেন চাচাজন পুরো বঙ্গোপসাগরটা যদি তেল হয়ে যায় তবু এই দেশের কোনো উন্নতি হবে না। দশজন লুটে পুটে খাবে।
কারেক্ট।
মনিরুদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।
আচ্ছা বাবা যাও।
জারী উঠে দাঁড়াল। জর্দার কড়া গন্ধে তার মাথা ধরে গেছে। বমি বমি আসছে।
বাসার সামনে বিশাল লাল রং এর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খাকি পোষাক এবং মাথায় টুপি পরা এক জন ড্রাইভার।
মুনিরুদ্দিন গাড়িতে উঠেই বলল, কুদ্দুস রবীন্দ্র সংগীত দাওতো। আমার আবার গাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। আর শোন কুদ্দুস স্লো চালাবে।
কুদ্দুস রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট চালু করল। মনিরুদ্দিন জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, খানিকটা ঘুরাঘুরি করি।
জরী বলল, জী আচ্ছা।
চীন বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ ব্রিজ দেখেছ?
না।
কুদ্দুস ঐ খানে চলতো।
গাড়ি চলতে শুরু করল। পেছনের সীটে এত জায়গা। তবু সে বসেছে জরীর সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে। জরী এখন তার গায়ের ঘামের গন্ধ পাচ্ছে।