আমি একা একা নিউ মার্কেটে ঘুরব? আপনি একটু আসুন না।
অয়ন নেমে পড়ল। মেয়েটা তাকে পছন্দ করে না তাতে কি। সেতো করে। আরো খানিকটা সময়তো পাওয়া যাচ্ছে মুনার সঙ্গে থাকার। এটাই বা কম কি। অয়ন গম্ভীর গলায় বলল, যা কেনার চট করে কেন, আমার কাজ আছে।
আমার পাঁচ মিনিট লাগবে।
পাঁচ মিনিটেই শেষ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই আমার হাতে ঘণ্টা খানিক সময় আছে।
পাঁচ মিনিটও আমার লাগবে না-তিন মিনিটে কেনা শেষ করে ফেলব।
অয়ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে আশা করতে লাগল। তিন মিনিটে নিশ্চয়ই কেনা কাটা শেষ হবে না। মেয়েদের পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব। মুনা অসম্ভবই সম্ভব করল। দুই মিনিটের ভেতর একটা প্যাকেট হাতে দোকান থেকে বের হয়ে বলল, চলুন যাই।
কেনা শেষ?
হুঁ।
এত তাড়াতাড়ি কি কিনলে?
আগে থেকে পছন্দ করা ছিল, শুধু টাকাটা দিলাম। এখন আপনি যেখানে যেতে চান—চলে যান, আমি আজিমপুর রীতাদের বাসায় যাব।
ইয়ে চা খাবে না-কি? এখানে একটা রেস্টুরেন্টে খুবই ভালো চা বানায়।
ভালো চা আপনি খান। আমার চা খাওয়ার শখ নেই। যাই কেমন? ও আচ্ছা! ধরুন, আপনার জন্যে একটা চিঠি আছে।
অয়ন বিস্মিত হয়ে বলল, চিঠি?
হ্যাঁ চিঠি। আর এই প্যাকেটটা রাখুন। এ রকম ট্যারা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। দেখতে বিশ্ৰী লাগছে।
হতচকিত অয়নের হাতে প্যাকেট এবং চিঠি দিয়ে মুনা ভিড়ের মধ্যে মিশে
গেল। সংক্ষিপ্ত চিঠি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা।
অয়ন ভাই,
আপনি পুরো শীতকালটা হাফ হাতা একটা স্যুয়েটার (তাও ফুটো হওয়া) পরে কাটালেন। এই একই স্যুয়েটার আপনি গত শীতেও পরেছেন। আমার খুব কষ্ট হয়। আপনাকে ভালো কটা স্যুয়েটার উপহার দিলাম। সেন্ট মার্টিনে যখন যাবেন তখন সেটা যেন গায়ে থাকে।
মুনা।
পুনশ্চ : যতই দিন যাচ্ছে আপনি ততই বাঁটু হচ্ছেন। ব্যাপার কি বলুনতো?
প্যাকেটের ভেতর হালকা আকাশী রং এর একটা ফুল হাতা স্যুয়েটার। যেন দূর আকাশের ছোট্ট একটা অংশ সাদা রং এর পলিথিনের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। অয়নের কেমন যেন লাগছে। জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে। শরীরে এক ধরনের কম্পন। কেন জানি শুধু মার কথা মনে পড়ছে, পনেরো বছর আগে যিনি মারা গেছেন তাঁর কথা হঠাৎ মনে পড়ছে। কেন? যিনি খুব শখ করে তার নাম রেখেছিলেন অয়ন। সেই মধুর নামে আজ আর কেউ তাকে ডাকে না। খাওয়ার শেষে কেউ বলে না, অয়ন বাবা পেট ভরেছে? খেয়েছিস ভালো করে?
অয়নের চোখে পানি এসে গেছে।
সে সেই অশ্রুজল গোপন করার কোনো চেষ্টত্ব করল না। কিছু কিছু চোখের জলে অহংকার ও আনন্দ মেশা থাকে, সেই জল গোপন করার প্রয়োজন পড়ে না।
মুনা বাড়িতে পা দেয়া মাত্র ফরিদা ভীত গলায় বললেন, পাউডারের কৌটায় এক হাজার টাকা ছিল। টাকাটা পাচ্ছি না-কি হয়েছে বলতো?
মুনা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলল, সেকি।
ফরিদা বললেন, আমারতো মা হাত পা কাঁপছে এখন কি করি?
ভালো করে খুঁজে দেখেছ? চলতো দেখি আমিও খুঁজি।
ফরিদা বললেন, একটা ঠিka ঝি রেখেছিলাম না? আমার মনে হয় ঐ নিয়ে গেছে।
সেতো গেছে দশদিন আগে এর মধ্যে তুমি খুঁজে দেখনি?
না।
আজেবাজে জায়গায় তুমি টাকা রাখা কেন মা? পাউডারের কৌটায় কেউ টাকা রাখে? কোথায় ছিল কৌটা?
কি হবে বলতো মুনা? সঞ্জুকে দেবী টাকাটা। সেতো এখনি চাইবে।
মুনার মুখ ছাই বর্ণ হয়ে গেল। ভাইয়া, ভাইয়া যেতে পারবে না? সে টাকা চুরি করেছে বলে তার ভাইয়া যেতে পারবে না? সেতো টাকা চুরিও করে নি। ধার নিয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি স্কলারশীপের পনেরশ টাকা পাবে। সে ঠিক করে রেখেছিল টাকাটা পাওয়ামাত্র সে পনের শ টাকাই মার কোটায় রেখে দেবে। মা একদিন কোটা খুলে অবাক হয়ে বলবেন, ও মুনা দুইটা পাঁচশ টাকার নোট রেখেছিলাম। এখন দেখি পনের শ টাকা। ব্যাপারটা কি বলতো?
সে বলবে, কি যে তুমি বল মা। টাকা কি আর ডিম দেয়। তুমি পনের শো রেখেছিলে।
উঁহু। আমি রেখেছি। আমি জানি না?
তাহলে নিশ্চয় ভৌতিক কাণ্ড। কোন পরোপকারী ভূত কিংবা পেত্নী হয়ত রেখে গেছে।
তুই রাখিস নি তো?
আমি? আমি রাখব কি ভাবে? আমি কি টাকা পাই? হেঁটে হেঁটে কলেজ করি। লোকজনদের ধাক্কা খেতে খেতে কলেজে যাওয়া ফিরে আসা। কি যে বিশ্ৰী তুমি তো জান না।
ফরিদা বললেন, এখন কি করি মুনা বলতো?
মুনা বলল, বাবার কাছে নেই?
উনার কাছে থাকবে কোথেকে? উনিতো বেতন পেয়েই সব টাকা আমার কাছে এনে দেন।
তাহলে কি বড় মামার অফিসে চলে যাব। বড় মামাকে বলব?
ফরিদা অকুলে কুল পেলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, তাই কর মা তাই কর।
মুনা ঘর থেকে বেরুতেই সঞ্জু বলল, টাকাতো মা এখনো দিলে না।
ফরিদা বললেন, তুই যাবি সেই রাত দশটায় এখন টাকা দিয়ে কি করব?
সঞ্জু শংকিত গলায় বলল, সত্যি করে বল মা। টাকার জোগাড় হয়েছে?
হয়েছে রে বাবা হয়েছে।
সঞ্জুর মুখ থেকে শংকর ভাব পুরোপুরি দূর হলো না। সে মার দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদার মুখ শুকনো। তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। হাসতে পারলেন না। কোনো রকমে বললেন, চা খাবি বাবা? চা বানিয়ে দেই?
জরী দোতলার বারান্দায়
জরী দোতলার বারান্দায় চুল এলিয়ে বসে আছে।
শীতকালে রোদে বসে থাকতে এমন ভালো লাগে। আজ ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস ছিল। ভোরবেলাতেই বাবা বলে দিয়েছেন, যেতে হবে না।
সে বলেছে, আচ্ছা। কেন যেতে হবে না জিজ্ঞেস করে নি। এই বাড়ির কারো সঙ্গেই কথা বলতে তার ইচ্ছা করে না। বাবার সঙ্গে না, মায়ের সঙ্গে না, ছোট বোনের সঙ্গেও না। তার প্রায়ই মনে হয় সে যদি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে পারত। তাহলে কত চমৎকার হত। সিঙ্গেল সিটেড একটা রুম। সে একা থাকবে। নিজের মতো করে ঘরটা সাজাবে। তাকে বিরক্ত করার জন্যে কেউ থাকবে না। দুপুর রাতে তার ঘরে দরজা ধাক্কা দিয়ে মা বলবেন না—ও জরী তোর সঙ্গে ঘুমুবব। তোর বাবা বিশ্ৰী ঝগড়া করছে। জরীকে দরজা খুলে বলতে হবে না, সে কি মা। কেঁদো না। দুপুর রাতে এ রকম শব্দ করে কাঁদতে আছে? বাড়ির সবাইকে তুমি জাগাবে।