শিলিগুড়িতে একটা ধর্মশালায় এক রাত ছিলাম। ভাড়া কত জনিস? এক টাকা। ঐ ধর্মশালাতে থাকাই আমার কাল হলো। সকালে উঠে দেখি টাকা পয়সা সব চুরি হয়ে গেছে। পায়জামা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে কম্বলের নিচে শুয়েছিলাম। পায়জামা পাঞ্জাবী ছাড়া আর কিছুই নেই। হা-হা-হা।
তিনি যেভাবে হাসছেন তাতে মনে হচ্ছে ঐ সময়কার খারাপ অবস্থাটাও খুব মজার ছিল। যদিও মজার হবার কোনোই কারণ নেই। বিদেশে টাকা পয়সা চুরি হয়ে যাওয়া তো ভয়াবহ।
তারপর কি হলো শোন—আমার বিছানার পাশের বিছানায় ঘুমুচ্ছিলেন এক সাধুবাবা। তিনি বললেন, ক্যা হুয়া লেড়কী? আমি বললাম, সব চুরি গেছে।
বাংলায় বললেন? না বাংলায় বললে কি বুঝবে? আমি ভাঙ্গা চোরা হিন্দীতে বললাম। এক চোরানে সব লে কর ভাগ গিয়া।
গল্পের এই পর্যায়ে মুনা ঘরে ঢুকে বলল, ভাইয়া বল্টু ভাই এসেছে। সঞ্জু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এখন বাবার সামনে থেকে উঠে যাবার একটা অজুহাত পাওয়া গেল। সে বলল, বাবা আমি একটু আসছি।
বল্ট চুল কাটিয়েছে।
গায়ে মেরুন রঙের হাফ হাওয়াই সার্ট। সার্ট নতুন কেনা হয়েছে। সুয়েটারে একটা ফুটো আছে বলে স্যুয়েটার পরেছে সার্টের নিচে। সঞ্জুকে দেখেই বলল, বিরাট কেলেংকারীয়াস ব্যাপার হয়েছে। শুভ্ৰকে টেলিফোন করেছিলাম, ধরেছেন শুভ্রর বাবা। উনার গলা অবিকল শুভ্রর মতোন। আমি বললাম, কে কানী বাবা নাकि? তোর কাছে এক্সট্রা হ্যান্ডব্যাগ আছে? কি অবস্থা দেখতো।
উনি কি বললেন?
কি বললেন ভালো করে শুনতেই পারি নি। ভয়ে তখন আমার ব্রেইন ঠাণ্ডী মেরে গেছে। সঞ্জু তোর কাছে এক্সট্রা হ্যান্ডব্যাগ আছে?
না।
আমি একটা জোগাড় করেছি। সেটার আবার চেইন লাগে না।
তুইতো আর হীরা-মুক্তা নিয়ে যাচ্ছিস না। চেইন না লাগলেও কিছু না।
তা ঠিক।
তোর যাওয়া কি হবে? তুই যে বলছিলি রাত আটটার আগে বলতে পারবি না।
রাত আটটার সময় টাকা পাওয়ার কথা। যদি পাই তবেই যাওয়া হবে। না পেলে না আমি প্রাইভেট টিউশ্যানী করি না? আমার ছাত্রকে বলে রেখেছি। মানে ধার হিসেবে চেয়েছি। সে বলেছে জোগাড় করে রাখবে। তোর টাকা জোগাড় হয়েছে?
মার কাছ থেকে নিচ্ছি।
তুই সুখে আছিস। টাকা চাওয়ার লোক আছে। আমার অবস্থাটা দেখ ছাত্রের কাছে টাকা ধার চাইছি।
সঞ্জু বলল, চা খাবি?
না। ব্যাগের সন্ধানে বের হব। সব রেডি রাখি যদি টাকা পাওয়া যায়। তুই মুনাকে একটু ডাকতো। মুনা বলছিল নিউ মার্কেট যাবে। আমি ঝিকাতলা যাব, নিউ মার্কেটে ওকে নামিয়ে দেব।
মুনার কথা বলতে গিয়ে বল্টুর বুক ধ্বক ধ্বক করছিল। সব সময় মনে হচ্ছিল সঞ্জু আবার কিছু বুঝে ফেলছে নাতো? সে অবশ্যি প্রাণপণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু মনের ভাব কতদিন আর গোপন থাকবে? মুনার কথা মনে হলে শরীরে কেমন যেন এক ধরনের কাঁপুনি হয়। কথা বলতে গেলে কথা বেঁধে যায়। কি যে সমস্যা হয়েছে। সঞ্জু তাঁর প্রাণের বন্ধু। সে যদি তার মনের ভাব কোনোদিন জেনে ফেলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে। অবশ্যি সঞ্জু এখনো কিছুই বুঝতে পারে নি। সে যে এই বাড়িতে একটু সেজে গুজে আসে তাও লক্ষ্য করে নি।
তবে মুনার ব্যাপারটা সে এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। বাচ্চা মেয়ে মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে অথচ কথাবার্তার মার প্যাঁচ অসাধারণ। প্রতিটি কথার দুইটা তিনটা মানে হয়। কোন মানেটা রাখবে, কোনটা রাখবে না সেটাই সমস্যা।
রিকশায় উঠেই বল্টু রিকশাওয়ালাকে বলল, হুড় তুলে দাওতো।
মুনা বলল হুড় তুলতে হবে কেন?
কে কি মনে করে।
মুনা বলল, মনে করা করির কি আছে? ভাই-বোন রিকশা করে যাচ্ছি।
বল্টর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ভাই বোন মানে? এসব কি বলছে মুনা। বল্টু মুখের মন খারাপ ভাব আড়াল করার জন্যে সিগারেট ধরাল। মুনা বলল, বল্টু ভাই, আজ আপনাকে আরো বাঁটু বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপার কি বলুনতো? আপনি কি কোমরে টাইট করে বেল্ট পরেছেন?
তোমাকে কতবার বলেছি আমাকে বল্টু ভাই ডাকবে না। আমার ক্লাসের বন্ধুরা ডাকে সেটা ভিন্ন কথা। তুমি ডাকবে কেন?
মনের ভুলে ডেকে ফেলি। আর ভুল হবে না এখন থেকে অয়ন ভাই ডাকব। আচ্ছা অয়ন মানে কি?
ঐ ইয়ে পৰ্বত।
আপনার মতো বাঁটু লোকের নাম পর্বত? আশ্চর্য তো।
অয়নের মন আরো খারাপ হয়ে গেল। মুনা বলল, আপনি সত্যি জানেন। অয়ন মানে পর্বত?
জানব না কেন? নিজের নামের মানে জানব না?
উঁহু, আপনি জানেন না। আমি চলন্তিকায় দেখেছি। অয়ন হচ্ছে পথ। সূর্যের গতি পথ। অয়নাংশ মানে সূর্যের গতিপথের অংশ।
অয়নের মনটা ভালো হয়ে গেল। এই মেয়ের মনে তার প্রতি সিরিয়াস ধরনের ফিলিংস আছে। ফিলিংস না থাকলে চলন্তিকা থেকে নামের মানে বের করত না। অবশ্যিই ফিলিংস আছে। অবশ্যই।
অয়ন ভাই।
কি?
আপনার নাম নয়ন হলে ভালো হত। আপনার চোখ সুন্দর।
কি যে তুমি বল।
তবে আলাদা আলাদা করে দেখলে সুন্দর। দুইটা চোখ একত্রে দেখলে মনে হয় একটা একটু ট্যােরা। আপনি লক্ষ্য করেছেন?
অয়ন কিছু বলল না। পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল মুনার তার প্রতি কোন রকম আকর্ষণ নেই। ফাজলামী করে বেড়াচ্ছে। এর বেশি কিছু না। মাঝে মাঝে আচমকা যে সব আবেগের কথা বলে তাও নিশ্চয়ই এক ধরনের রসিকতা। অল্পবয়েসী মেয়েরা ক্রুর রসিকতা পছন্দ করে। বিশেষ করে সেই মেয়ে যদি অসাধারণ রূপবতী হয় তাহলেতো কথাই নেই।
মুনা, নিউ মার্কেট এসে গেছে তুমি এখানে নাম, আমি এই রিকশা নিয়েই চলে যাব।