শুভ্ৰ এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এক ধরনের বিস্ময় অনুভব করছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, চিটাগাং থেকে কক্সবাজার তুমি ওদের ব্যবস্থামতোই যাবে, কিন্তু কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাবার পথে আবার মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করবে। ঝকঝকে মাইক্রোবাস।
কি ভাবে করব?
তোমাকে কিছুই করতে হবে না। ব্যবস্থা করা থাকবে। এতে যা হবে তা হচ্ছে সবাই জানবে তুমি ইচ্ছা করলেই চমৎকার ব্যবস্থা করতে পাের, কিন্তু সেই ইচ্ছা তোমার সব সময় হয় না। তোমার উপর এক ধরনের ভরসা তারা করতে শুরু করবে। তোমার প্রত্যক্ষ প্রভাব সবার উপর পড়তে শুরু করবে।
টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে যাবার জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া যায়। ঐ সব নৌকা করেই তুমি যাবে, তবে নৌকা যদি ছোট হয় এবং সমুদ্রে যদি ঢেউ বেশি থাকে তাহলে টেকনাফের বিডিআর ক্যাম্পে যাবে। ওদের একটা ট্রলার আছে। যে ট্রলারের সাহায্যে ওরা সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডের বিডিআর আউট পোষ্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ওদের খবর দেয়া আছে। তুমি চাওয়া মাত্র ওরা তোমাকে সাহায্য করবে।
শুভ্র বলল, বাবা আমি এসব কিছুই করতে চাই না।
চাও না?
জ্বি না।
ভালো কথা। না চাইলে করতে হবে না। তবে রাতে ট্রেনের কামরা রিজার্ভ থাকবে এবং কক্সবাজারে হোটেল সায়মনের সামনে মাইক্রোবাস থাকবে। তুমি যদি মত বদলাও তাহলে এই সুবিধা নিতে পার।
আমি মত বদলাব না। আমি যেমন আছি তেমন থাকতে চাই বাবা। আমি কারোর উপর কোনো প্রভাব ফেলতে চাই না।
তোমার স্বাধীন ইচ্ছায় আমি হস্তক্ষেপ করব না-তবে ব্যবস্থা সবই থাকবে।
টেলিফোনে রিং হচ্ছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন। হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে শোনা গেল,
কে কানা-বাবা? তোর কাছে একস্ট্রা হ্যান্ড ব্যাগ আছে। আমাকে দিতে পারবি।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি ধরে থাক। আমি কানাবাবাকে দিচ্ছি।
টেলিফোন করেছিল বল্টু। সে খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখল।
সঞ্জুর জিনিসপত্র গোছগাছ করা হচ্ছে
সঞ্জুর জিনিসপত্র গোছগাছ করা হচ্ছে।
গোছানোর কাজটা করছেন ফরিদা। সঞ্জু বলল, তুমি কষ্ট করছ, কেন মা? দাও আমাকে দাও।
ফরিদা ধমক দিলেন, তুই চুপ করে বসতো। চা খাবি? ও মুনা যা ভাইয়ার জন্যে চা বানিয়ে আনা। আমাকেও একটু দিস। আর তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয় সে খাবে না-কি।
সঞ্জু বলল, বাবা অফিসে যান নি?
না।
জ্বরতো কমেছে। জ্বর কমেনি?
হ্যাঁ কমেছে। তুই আজ চলে যাচ্ছিস-তাই অফিসে গেল না।
সে কি?
সঞ্জুর সত্যি সত্যি লজ্জা করতে লাগল। বাবা অফিসে না গিয়ে ঘরে বসে থাকার সঙ্গে তার বেড়াতে যাবার সম্পর্কটা সে ঠিক ধরতে পারছে না।
ফরিদা বললেন, যা তুই তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে আয়।
আমি কি কথা বলব? বাবাকে দেখলেই আমার হার্ট বিট স্লো হয়ে যায়।
কি যে তুই বলিস। উনি কি জীবনে তোদের বকা দিয়েছেন না-কি উঁচু গলায় একটা কথা বলেছেন?
তবু বাবাকে সাংঘাতিক ভয় লাগে মা। তুমি ঐ বদ-রঙ্গা শালটা দিচ্ছ কেন?
তোর বাবা বলেছে সঙ্গে নিয়ে যেতে। নিয়ে যা। না নিলে উনি মনে কষ্ট পাবেন। আর শোন বাবা, যা উনার কাছে গিয়ে বস, একটু গল্প টল্প কর।
কি গল্প করব বলতো?
গল্প না করলে না করবি। সামনে গিয়ে বস।
সঞ্জু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে গেল।
সোবাহান সাহেব খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
সঞ্জুকে ঢুকতে দেখেও খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললেন না। মৃদু স্বরে বললেন, বস।
সঞ্জু বসল।
এমনভাবে বসিল যেন বাবার মুখোমুখি হতে না হয়। সোবাহান সাহেব বললেন, সাদামকে তোর কেমন মনে হয়?
প্রশ্নটি এতই অপ্রত্যাশিত যে সঞ্জু পুরোপুরি হকচাকিয়ে গেল। সোবাহান সাহেব বললেন, স্কাড জিনিসটাতো দেখি খুবই মারাত্মক।
কিছু না বললে ভালো দেখায় না বলেই সঞ্জু বলল, খুব মারাত্মক না। পেট্রিয়ট দিয়েতো শেষ করে দিচ্ছে।
আরে না। এই সব ওয়েস্টার্ন প্রেসের কথা বার্তা। একটাও বিশ্বাস করবি না। সাদ্দাম সহজ পাত্র না। বুশের কাল ঘাম বের করে দিয়েছে। এই ঝামেলা হবে আগে জানলে সে মিডলইস্টের ত্রিসীমানায় আসত না।
মিডল ইস্টের আলোচনায় যাবার কোনো রকম ইচ্ছা সঞ্জু অনুভব করছে না। অথচ সে বুঝতে পারছে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা খুবই উচিত। বাবা তাই চাচ্ছেন। কেমন বন্ধুর মতো গলায় কথা বলছেন। যিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কখনো কথা বলেন না। তিনি যদি হঠাৎ বন্ধুর মতো আচরণ করতে থাকেন তাহলে বিরাট সমস্যা হয়।
মুনা চা নিয়ে আসায় পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হলো। কিছু একটা করার সুযোগ পাওয়া গেছে। চা খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা যাবে।
চায়ে চিনি হয় নি। বিস্বাদ তিতকুট খানিকটা তরল পদার্থ, যার উপর খুব কম হলেও চারটা পিপড়া ভাসছে। মুনা যতই দিন যাচ্ছে ততই গাধা হচ্ছে। বাবা সামনে না থাকলে ধমক দিয়ে দেয়া যেত। এখন ধমক দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। হাসি হাসি মুখ করে চা খেয়ে যেতে হবে। মুড়ি ভিজিয়ে লোকজন যেমন চা খায় তেমনি পিপড়া ভিজিয়ে চা খাওয়া। সঞ্জু এক চুমুকে সব কটা পিপড়া খেয়ে ফেলল।
সোবাহান সাহেব বললেন, তোমার মতো বয়সে আমি একবার ঘুরতে বের হয়েছিলাম। দাৰ্জিলিং গিয়েছিলাম। বেনাপোল হয়ে কলকাতায়। সেখান থেকে বাসে করে শিলিগুড়ি।
সঞ্জু চুপ করে রইল। সোবাহান সাহেব কোলের উপর বালিস টেনে নিয়েছেন। এটা তাঁর দীর্ঘ আলাপের প্রস্তুতি কি-না তা সঞ্জু বুঝতে পারল না। বাবার সব কথা বার্তাই সংক্ষিপ্ত আজ কি তাঁকে কথা বলার ভূতে পেয়েছে? এত কথা বলছেন কেন?