অপছন্দের কথাটা তাহলে তুমি তোমার বাবা-মাকে বল।
উনাদের বলা সম্ভব না।
কেন সম্ভব না, জানতে পারি?
আমরা বড় চাচার সঙ্গে থাকি। আমার বাবা কিছুই করেন না। উনি বড় চাচার আশ্রিত বলতে পারেন। এই বিয়ে বড় চাচা ঠিক করেছেন, তাঁর বন্ধুর ছেলে। আমার না বলার কোনো উপায় নেই।
তোমার নিজের পছন্দের কোনো ছেলে কি আছে?
জ্বি না।
কি ধরনের ছেলে তোমার পছন্দ বলতো শুনি। সব মেয়ের মনে স্বামী সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা থাকে। তোমার ধারণাটা জানতে ইচ্ছা করছে।
ঐসব নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি চাচা।
মনসুর আলি সাহেবের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটা তার সঙ্গে খেতে না বসলেই ভালো হত। মেয়েটা তাঁর মন অসম্ভব খারাপ করে দিয়েছে। মন খারাপ হলেই রক্তে শরীরের ডাক প্রবল হয়ে উঠে। ভালো লাগে না। সমুদ্রের কাছ থেকে তিনি এখন মুক্তি চান। মুক্তি।
আনুশকাদের ঘরে এখন তুমুল ঝগড়া চলছে। ঝগড়া করছে নইম এবং ইলোরা। ঝগড়ার কারণ হচ্ছে ইলোরা নইমাকে ওয়েল ট্যাংকার বলেছে। নাইমাকে ওয়েল ট্যাংকার আজ প্রথম বলা হলো না। আগেও ফিস ফিস করে তাকে এই নামে ডাকা হয়েছে। তার শরীরের বিশালত্বের সঙ্গে নামটার একটা যোগসূত্র আছে বলেই নইম এই নাম সহ্য করতে পারে না।
নাইমা এবং ইলোরার বাক্যযুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চলছে। আনুশকা একটু দূরে হাসি মুখে বসে আছে। নীরা, আনুশকার পাশে। তারা দুই জনে ফিস ফিস করছে এবং চাপা হাসি হাসছে। নীরা বলল, আনুশকা আজকের বাক্যযুদ্ধে কে জিতবে?
আনুশকা বলল, ইলোরা। ওর সঙ্গে কথায় পারা মুশকিল।
উঁহু। জিতবে নইমা। নইমা অশ্লীল ইংগিত করে ইলোরাকে রাগিয়ে দেবে। রাগলে ইলোরার লজিক কাজ করে না। উল্টাপাল্টা কথা বলে। তুই নিজেই দেখ আস্তে আস্তে কেমন রাগাচ্ছে।
তুই কি আমার সঙ্গে একশ টাকা বাজি রাখবি?
আচ্ছা বেশ একশ টাকা বাজি।
বাজি রেখে দুই জন আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।
ইলোরা ঠাণ্ডা কথার প্যাঁচে নইমাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। নইমা কথা বলছে উঁচু গলায়। আনুশকা ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিয়েছে যাতে আওয়াজ বাইরে না যায়। আর কেউ যেন কিছু শুনতে না পায়।
ইলোরা বলছে, ওয়েল ট্যাংকার বলায় এত রাগিস কেন? ওয়েল ট্যাংকার বললেতো তোকে অনেক কম বলা হয়। ফুলে ফেঁপে তুই যা হয়েছিস তোকে হিপোপোটমাস ডাকা উচিত। তোর ঘাড় গর্দান সব এক হয়ে গেছে।
আমার ঘাড় গর্দন সব এক হয়ে গেছে?
হুঁ। তুই যখন রাস্তা দিয়ে যাস তখন আশেপাশের লোকজন তোকে দেখে খুব আনন্দ পায়। এই রকম দৃশ্য তো সচরাচর দেখা যায় না।
এই রকম দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না?
না। যতই দিন যাচ্ছে দৃশ্য ততই মজাদার হচ্ছে। আচ্ছা ডেইলি তোর ওজন কত করে বাড়ে? এক কেজি না দুই কেজি?
তোর নিজের ধারণা তুই রাজকুমারী? আমাকে নিয়ে তো কথা হচ্ছে না। তোকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তুই ওয়েল ট্যাংকার কি-না তাই নিয়ে বিতর্ক।
নাইমা আর পারল না। হঠাৎ কেঁদে ফেলল। ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কান্না।
আনুশকা, নীরাকে বলল—দে টাকা দে। তুই বাজিতে হেরেছিস।
নীরা, ব্যাগ খুলে টাকা বের করল। ওদের অতি প্রিয় এক জন বান্ধবী যে শিশুদের মতো কাঁদছে। ঐ দিকে তাদের কোনো নজর নেই।
জীবনের এই অংশটা বড়ই মধুর। আনুশকা উঠে গিয়ে ইংরেজি গান দিয়ে দিয়েছে। সুর ছড়িয়ে পড়েছে। সারা ঘরে
Don’t make my brown eyes blue…
নাইমা চাপা স্বরে বলল, গান বন্ধ করা।
আনুশকা বলল, গান বন্ধ করব কেন? তুই কাঁদছিস বলে আমাদেরও কাঁদতে হবে নাকি?
ইলোরা এবং নীরা এক সঙ্গে হেসে উঠল, সেই হাসিতে নইমাও যোগ দিল।
নীরা বলল, তুই চট করে কেঁদে আমার একশ টাকা লস করিয়ে দিলি। তুই জিতবি, এই নিয়ে একশ টাকা বাজি ছিল। তুই যত মোটা হচ্ছিস তোর বুদ্ধিও ততো মোটা হচ্ছে।
আবার সবাই হেসে উঠল।
নীরা বলল, রবীন্দ্র সংগীত দে ভাই, ইংরেজি ভালো লাগছে না।
ইলোরা বলল, ফর গডস সেক, রবীন্দ্র সংগীত না। সখী ভালোবাসি ভালোবাসি এই সব গান আমার অসহ্য।
অসহ্য হলেও উপায় নেই। আনুশকা রাজেশ্বরী দত্তের রেকর্ড খুঁজতে শুরু করেছে।
আনুশকা বলল, শুরুর বাজনাটা শুনে কেউ যদি বলতে পারিস এটা কোন গান তাহলে তাকে আমি পাঁচশ টাকা দেব। মন দিয়ে শোন—রেকর্ড বাজতে শুরু করেছে।
সবাই চুপ করে আছে। সেতারের হালকা কাজ। কোন গান বোঝা যাচ্ছে না।
গান হচ্ছে। রাজশ্বেরী দত্তের কিন্নর কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। চারটি তরুণী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিবে যায় বারে বারে
আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে।
যাত্রা-দিবস
আজি মঙ্গলবার
ভোর সাতটা।
চায়ের টেবিলে শুভ্র এবং ইয়াজউদ্দিন সাহেব বসে আছেন। রেহানা নেই। তিনি রান্নাঘরে। ভাপা পিঠা বানানো হচ্ছে। তার তদারকি হচ্ছে। পিঠাগুলো কেন জানি কিছুতেই জোড়া লাগছে না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, আইজতো তোমাদের যাত্রা।
শুভ্ৰ মাথা নাড়ল।
সব ঠিক ঠাক আছে তো?
আছে।
রাতের ট্রেনে যাচ্ছ?
জ্বি
টিকেট কাটা হয়েছে?
না। স্টেশনে গিয়ে কাটা হবে।
এডভান্স কাটা হলো না কেন?
সবাই যাবে কিনা এখনো ফাইন্যাল হয়নি। যাদের যাবার কথা তার চেয়ে কয়েকজন বেশিও হতে পারে। আবার যাদের যাবার কথা তাদের মাঝখানে থেকে কেউ কেউ বাদ পড়তে পারে।
অনেক আগে থেকেইতো প্রোগ্রাম করা। বাদ পড়বে কেন?