১. মৃন্ময়ী চৌধুরী
২. রাজেশ্বরী
৩. চিত্রা সেন
কেউ কেউ বলতে পারে, হিন্দু নাম। আমি বলব, নামের আবার হিন্দু মুসলমান কী? নাম কি কখনো কলেমা পড়ে মুসলমান হয়েছে?
আহসানকে বিয়ে করলে বাবার একটা সমস্যা হবে। ছোট সমস্যা না, বেশ বড় সমস্যা। বাবা শুধু যে আহসানের বন্ধু তা না, বাবা তার কর্মচারী।
কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো। আহসানের তিনতলা বাড়ির একতলার তিনটি রুমে বিনা ভাড়ায় বাবা থাকেন। বিনিময়ে ভাড়াটেদের সমস্যা দেখেন। বাথরুমের কল নষ্ট হয়ে গেলে মিস্ত্রি ডেকে দেন। ইলেকট্রিক লাইনের সমস্যা দেখেন। দুপুরের পর আহসানের এ্যারাম ইন্টারন্যাশনাল অফিসে বসেন। সেখান থেকে বেতন কত পান আমি জানি না, তবে খুব বেশি পান না। কারণ বেশ। টানাটানি করেই আমাদের সংসার চলে।
আহসানের অনেক টাকা। একবার যাদের অনেক টাকা হয়ে যায়, তাদের টাকা বাড়তেই থাকে। আহসানের টাকা শুধু বাড়ছে। সে টাকা খরচ করতে জানে না। আমি জানি। বিয়ের পর ধুমসে খরচ করব। টয়লেটেও এসি লাগাব। বারো ইঞ্চি কালার টিভি বসাব।
বছরে তিন মাস বাইরে বাইরে ঘুরব। প্রথমে যাব শ্রীলংকা। হুমায়ূন হাফমেড শ্রীলংকা ঘুরে এসে একটা বই লিখেছেন, নাম রাবণের দেশে। ওই বইটা পড়ে আমার শ্রীলংকা যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে।
.
বাসায় খিচুড়ি হাঁসের মাংস রান্না হচ্ছে। আর আমি আহসানের সঙ্গে দাবা নিয়ে বসেছি। আমার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এসেছে। আজ তাকে দ্রুত হারিয়ে দিলে কেমন হয়? পুচকি এক মেয়ের কাছে হার মানুষটা কীভাবে নেবে?
আমি মনে মনে চাল গুনছি। আঠার চালের মাথায় আমি ঘোড়ার চালে তাঁকে মাত করলাম। তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, মাত নাকি?
আমি বললাম, জানি না তো।
তিনি বললেন, রাজা নড়াবার জায়গা নেই।
আমি বললাম, তাই তো। কীভাবে হলো?
তিনি মুখ শুকনা করে বললেন, এসো আরেক দান খেলি।
আমি বললাম, না না, আর খেলব না। আপনি হেরে গেছেন। আমার খুব খারাপ লাগছে।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, খেলায় হার-জিত থাকবেই। বোর্ড সাজাও। এবার তুমি সাদা নাও।
দ্বিতীয় দফায় তাঁকে হারালাম পনের চালে।
তিনি তৃতীয়বার বোর্ড সাজালেন। আমি দেখলাম তাঁর মুখ হয়েছে পাংশুবর্ণ। চাল দেওয়ার সময় তার হাত অল্প অল্প কাঁপছে। মানুষটার জন্যে এমন মায়া লাগল। চোখে পানি আসার মতো হলো।
তৃতীয় খেলায় তিনি একুশ চালে মাত হলেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুমি দাবা খেলা ভালো জানো। এত দিন আমার সঙ্গে খেলা না-জানার অভিনয় করেছ। ঠিক বলেছি?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
অভিনয়টা কেন করলে?
একটা বাচ্চামেয়ের কাছে হার আপনি নিতে পারবেন না। এই ভেবে অভিনয় করেছি। আর করব না।
তিনি বললেন, কাঁদছ কেন?
আমি বললাম, আপনার জন্যে খুব খারাপ লাগছে, এইজন্যে কাঁদছি। আমি আপনার সঙ্গে আর কোনোদিনই দাবা খেলব না। আপনাকে আমার কাছে হারতে হবে না।
তুমি অদ্ভুত এক মেয়ে।
আমি অদ্ভুত না। আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে।
তিনি টিস্যুর বাক্স এগিয়ে দিয়ে বললেন, চোখ মোছো। Compose yourself.
আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি কিছু বলার আগেই দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হলাম। দরজার চৌকাঠে মাথা লেগে কপালের এক কোনা আলুর মতো ফুলে উঠল। মা আমাকে দেখে বললেন, তোর কপালে কী হয়েছে?
আমি বললাম, আমাকে মেরেছে, এইজন্যে কপাল ফুলেছে।
মা অবাক হয়ে বললেন, কে মেরেছে?
আমি বললাম, আহসান সাহেব মেরেছেন। আমার কাছে দাবায় হেরে তিনি দাবার বাক্স ছুঁড়ে মেরেছেন।
মা বললেন, কী বলছিস তুই?
আমি বললাম, মা সত্যি। আল্লাহর কসম।
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোদের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। উনার মতো মানুষ দাবা বোর্ড ছুঁড়ে মারবেন। এইসব কী?
আমি ঠিক করেছি উনার মাথায় একটা ডিকশনারি ছুঁড়ে মারব। উনি জ্ঞানী মানুষ তো, উনার জন্যে ডিকশনারি।
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ থেকে বিস্ময়বোধ দূর হচ্ছে না।
.
দুপুরে খেতে বসার ঠিক আগে আগে প্রতিমা উপস্থিত। আমি বললাম, প্রতিমা, তুই ভালো দিনে এসেছিস। আজ বাসায় হাঁস আর খিচুড়ি হচ্ছে।
খাবার টেবিলে বাইরের লোক থাকলে বাবা খুব খুশি হন। কেন খুশি হন তা জানি না। আমরা গরিব মানুষ। কেউ আমাদের খাবারে ভাগ বসালে আমাদের খুশি হওয়ার কথা না।
বাবা প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হাঁসের মাংসের কোন পিস তোমার পছন্দ বলো।
প্রতিমা বলল, কাকা, আপনার কোন পিস পছন্দ সেটা বলুন।
বাবা বললেন, রানের মাংস।
প্রতিমা বলল, তাহলে আমি নেব দুটা রান। আপনাকে রান খেতে দেব না।
এমন কিছু হাসির কথা না, কিন্তু বাবা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন।
প্রতিমা সত্যি সত্যি দুটা রান পাতে নিল। বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কাকা, আমি হাঁসের মাংস খাই না। আমার প্লেটটা আমি আপনার জন্যে সাজিয়েছি। আমি খিচুড়ি খাব ঝোল দিয়ে।
বাবা আবারও হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সকালে মানিব্যাগ এবং হাঁস হারানোর দুঃখ তিনি পুরোপুরি ভুলে গেছেন।
.
প্রতিমাকে আমি উপন্যাসের প্রথম পাতাটা পড়ালাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, শুরুটা আমার করার কথা না? একটা সেক্স-সিকোয়েন্স দিয়ে শুরু। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি। খুব রাগ করলাম। তোর সঙ্গে আর কথা বলব না। অংক মিসকে সেকেন্ড চিঠি যা পাঠাব, তাও পড়তে দিব না।