আমি নিজে কয়েকটা নতুন শব্দ বের করেছি। আমার উপন্যাসে শব্দগুলো দিয়ে দেব। শব্দগুলো এবং তার মানে–
ক : গরবত (গরবত হলো গরম শরবত)
খ : শীরবত (শীরবত হলো শীতল শরবত)
গ : ফামানুষ (ফাজিল মানুষ)।
ঘ : জ্ঞামানুষ (জ্ঞানী মানুষ। যেমন, আহসান সাহেব)
৬ : তর্কি (যে তর্ক করতে ভালোবাসে। যেমন, আমি।)
চ : নোংরি (যে মেয়ে নোংরা কথা বলতে পছন্দ করে। যেমন, প্রতিমা।)
উপন্যাসের আরও খানিকটা লেখা যেত, এর মধ্যে মা ইশারা করে আমাকে রান্নাঘরে যেতে বললেন। মা যখন বাবার আড়ালে কিছু বলতে চান, তখন তিনি রান্নাঘরে চলে যান। আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম। মা গলা নামিয়ে বললেন, তোর বাবার শুধু যে হাঁস আর বাজার গেছে তা না, পকেটমারও হয়েছে। রিকশায় উঠে দেখে পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগ নেই।
কত টাকা ছিল?
এক হাজার টাকার একটা নোট আর কিছু খুচরা টাকা। তোর বাবা মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আছে।
মন খারাপ করারই কথা।
তুই একটা কাজ করতে পারবি? তোর বাবার হাঁসের মাংস দিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার শখ ছিল। তুই একটা হাঁস কিনে আনতে পারবি? হাঁস আর পোলাওয়ের চাল।
পারব। টাকা দাও।
মা বললেন, তুই খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে।
আমি টাকা নিয়ে বাসার গেট থেকে বের হতেই আহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন। উনার একটা কালো রঙের টয়োটা গাড়ি আছে। ড্রাইভার গাড়ি চালায়। ড্রাইভারের নাম কিসমত। আহসান সাহেব বললেন, লিপি, কোথায় যাচ্ছ?
আমি বললাম, হাঁস কিনতে যাচ্ছি। বাসায় আজ হাঁস এবং খিচুড়ি রান্না হবে।
তোমাকে হাঁস কিনতে যেতে হচ্ছে কেন? তোমার বাবা কোথায়?
বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর মনে হয় শরীর খারাপ।
হাঁস আর কী লাগবে?
হাঁস আর পোলাওয়ের চাল।
আহসান সাহেব বললেন, তোমাকে হাঁস কিনতে যেতে হবে না। তুমি আমার ঘরে আসো, একদান দাবা খেলব। কিসমত হাঁস আর পোলাওয়ের চাল নিয়ে আসবে।
আমি বললাম, কিসমত ভাইকে টাকা দিতে হবে না?
আহসান সাহেব হেসে ফেলে বললেন, না।
ড্রাইভার কিসমত ভাইকে নিয়ে আমার একটা গল্প আছে। একদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, বাসায় কীভাবে ফিরব বুঝতে পারছি না। থম বৃষ্টির সময় ঢাকা শহরে কোনো রিকশা পাওয়া যায় না।
বৃষ্টিতে ভিজে আমি ফিরতে পারি, আমার ভালোই লাগবে। সমস্যা একটাই, মা-পায়জামা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকবে। সবাই তাকিয়ে দেখবে।
পুরুষমানুষের চোখ আনন্দে চকচক করবে। আমি কী করব ভাবছি, হঠাৎ দেখি কিসমত ভাই। আমি এগিয়ে গেলাম। কিসমত ভাই বললেন, আফা! স্যার গাড়ি পাঠাইছে।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ও আচ্ছা।
কিসমত ভাই গাড়ির দরজা খুলে দিলে আমি উঠে পড়লাম। আমার একবারও মনে হলো না–কোনোদিনও আমার জন্য গাড়ি পাঠানো হয় নি, আজ পাঠানো হলো কেন? এমন তো হতে পারে কিসমত আমাকে গোপনে কোনো আস্তানায় নিয়ে যাবে।
বরং আমার মনে হলো, আহসান সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সাভারে তাঁর বাগানবাড়ির মতো বাড়ি আছে। আমি সেখানে যাব। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। যাকে বিয়ে করব তার সঙ্গে বিয়ের আগে কিছু সময় কাটাতে অসুবিধা কী?
কিসমত ভাই বলল, আফা গান ছাড়ব?
আমি বললাম, হুঁ।
গাড়িতে গান হচ্ছে, শচীন কর্তার ডাকাতিয়া বাঁশি। আমি ভাবছি–বাহ ভালো তো, আমার জীবনের সঙ্গে মিল আছে। ডাকাতিয়া বাঁশি বাজছে, আমি চলে যাচ্ছি সাভারে।
ও আল্লা! গাড়ি আমাদের বাসার সামনে থামল। আমি সামান্য মন খারাপ করেই আহসান সাহেবের ঘরে স্কুল-পোশাক পরেই গেলাম। তিনি ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। আমাকে দেখে বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন, গাড়ি গিয়েছিল?
আমি বললাম, হুঁ।
আহসান সাহেব বললেন, বৃষ্টি দেখে গাড়ি পাঠিয়েছি। একদিন দেখলাম বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে ফিরছ।
আমি বললাম, থ্যাংক য়্যু।
আহসান সাহেব বললেন, আজও দেখি গা পুরোপুরি ভেজা। বাসায় যাও। ড্রেস চেঞ্জ করো।
আমি তার ঘর থেকে বের হলাম।
গাড়িতে আসার পরও এত ভিজলাম কীভাবে বলি। আহসান সাহেবের ঘরে ঢোকার আগে ছাদে গিয়ে পুরোপুরি ভিজেছি, যাতে কাপড় গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়। অন্য পুরুষের সামনে এভাবে যাওয়া যায় না, তবে যাকে বিয়ে করব তার সামনে যাওয়া যায়। শুধু যে যাওয়া যায় তা না, যাওয়া উচিত। আহসান সাহেব। ফিরেও তাকালেন না, এটাই সমস্যা।
ধুর ছাতা! আমি আহসান সাহেব, আহসান সাহেব করছি কেন? এখন থেকে আহসান ডাকব। মনে মনে ডাকব। তাকে তো আর বলতে পারি না, আহসান, কী বই পড়ছ? আমি তোমার পাশে বসছি, তুমি আমাকে পড়ে শোনাও।
বিয়ের পরেও যে আমি তাকে আহসান বলতে পারব তা মনে হয় না। এই শুনছ! ধরনের কিছু ডাকতে হবে।
আমার মা বাবাকে ডাকে লিপির বাবা। শুনতে অসহ্য লাগে। দুই অক্ষরের নাম হয়ে সমস্যা হয়েছে। আমার নাম যদি মৃন্ময়ী হতো তাহলে মা কথায় কথায়। মৃন্ময়ীর বাবা ডাকতে পারত না।
আমি আমার নাম বদলাব। ডাক নাম ভালো নাম দুটাই। বই যখন ছাপা হবে তখন তো নাম বদলাতেই হবে। আমার ভালো নাম হামিদা বানু। কঠিন। প্রেমের উপন্যাসের লেখকের নাম হামিদা বানু, এটা কখনো হয়? আহসানের কাছে সুন্দর একটা ছদ্মনাম চাইতে হবে। আমি কয়েকটা নাম ঠিক করে রেখেছি। যেমন