১. বাসার চাবি।
২. বাবার পার্কার কলমের মুখো।
৩. শ্যাম্পুর বোতল।
৪. রান্নাঘর থেকে নেওয়া ফলকাটার ছুরি।
৫. পাঁচ ছটা কচুর মুখি।
৬. বাবার ইনসুলিনের সিরিঞ্জ।
৭. একটা চায়ের কাপ।
দুতিন পৃষ্ঠার তালিকা দিতে পারি। সাতটার নাম দিলাম যাতে রুবেলের বিচিত্র জিনিস সংগ্রহের বিষয়টি বোঝা যাবে। আমার উপন্যাসে রুবেলের গাড়ির বড় ভূমিকা আছে। যথাসময়ে তা পরিষ্কার হবে।
বলতে ভুলে গেছি, আমি উপন্যাসের নাম বদলে দিয়েছি। এখন নাম দাঁড়কাকের সংসার। নামটা অদ্ভুত না? মাঝে মাঝে তব দেখা পাই নাম শুনলেই পাঠক বুঝে ফেলবে, এটা একটা প্রেমের উপন্যাস। শুরুতেই ব্যাপারটা আমি পাঠককে বোঝাতে চাচ্ছি না। তবে নামকরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয় নি। আমি একজন ঔপন্যাসিকের সাহায্য চাইব। তিনি হিমু, মিসির আলি লেখেন। তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের স্কুলের অনেক মেয়ে তাঁকে ডাকে হুমায়ূন হাফমেড। আহমেদের বদলে হাফমেড। তিনি নাকি অর্ধেক পাগল।
তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তার বাসার টেলিফোন নম্বরে গত শুক্রবার টেলিফোন করেছিলাম। একজন টেলিফোন ধরে বলল, স্যার রেস্টে আছেন। আমি দুপুর বারোটায় আবার টেলিফোন করলাম। ওই লোক আবার টেলিফোন ধরে বলল, স্যার রেস্টে আছেন।
আমি বললাম, রেস্টে আছেন মানে কী?
ঘুমাচ্ছেন।
সারা দিন ঘুমালে লেখালেখি কখন করবেন?
ওই লোক টেলিফোন রেখে দিল। আমি বিকাল চারটায় আবার টেলিফোন করলাম। আগের লোকই টেলিফোন ধরে বলল, স্যার রেস্টে আছেন।
আমি গলার স্বর গম্ভীর করে বললাম, আপনার স্যারকে গিয়ে বলুন আমার নাম শাহানা খানম। আমি ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর।
সে বলল, ম্যাডাম, লাইনে থাকুন। অনেকক্ষণ কানে টেলিফোন ধরে রাখার পর সে এসে আগের মতোই বলল, স্যার রেস্টে আছেন। আমি বললাম, আপনি কি উনাকে বলেছিলেন যে, আমি ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর?
বলেছিলাম।
উনি কী বললেন?
স্যার বলেছেন, ডিবি পুলিশের আমি কেঁথা পুড়ি।
এরপর আর টেলিফোন করার অর্থ হয় না। আমি বুঝে গেছি টেলিফোনের লাইনে হবে না। অন্য কোনো লাইন ধরতে হবে। এখনো কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছে না, তবে এসে যাবে।
আমি উপন্যাসের প্রথম লাইন লেখার জন্যে তৈরি হয়েছি। কলম হাতে নিয়ে তিনবার বললাম, রাব্বি জেদনি এলমান। এর অর্থ হচ্ছে, হে রব। আমাকে জ্ঞান দাও। পড়াশোনা বা লেখালেখি-বিষয়ক কর্মকাণ্ড শুরু করার আগে তিনবার এই দোয়া পাঠ করলে সাফল্য আসে। এই বিষয় আমাকে বলেছেন হুজুর একরাম।
বাবা হুজুর একরামকে রেখেছিলেন আমাকে কোরান মজিদ পড়া শেখানোর জন্যে। উনার সুফি নুরানি চেহারা। কথাবার্তা অতি মোলায়েম। ও আল্লা, একদিন পড়ার সময় দেখি তিনি পা দিয়ে আমার ডান পা ঘষছেন। আমি পা সরিয়ে নিলাম না। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম, তারপর বললাম, হুজুর! আমার বাঁ পা বেশি চুলকাচ্ছে। বাঁ পাটা আগে চুলকে দিন। তারপর যত ইচ্ছা ডান পা চুলকাবেন। হুজুর পা সরিয়ে নিলেন।
আমি মাকে ঘটনা বললাম। মা বললেন বাবাকে। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। কঠিন মুখ করে বললেন, লিপি, তোমার মনে আছে পাপ। আজকালকার মেয়েদের মন কলুষিত। পায়ের সঙ্গে পা লেগে গেছে এইটা নিয়ে তুমি দেনদরবার শুরু করেছ। তোমাকে থাপড়ানো দরকার। মানি লোকের মান রক্ষা করবে তা না, উল্টা অপবাদ। সামনে থেকে যাও। পড়া ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা!
আমি যথারীতি হুজুরের সঙ্গে পড়া শুরু করলাম, তবে দ্বিতীয় দিনে জুতা পরে বসেছি। জুতার আগা দিয়ে কষে তার পায়ে গুতা দিলাম। তিনি আউ বলে চিৎকার দিলেন। কিছুক্ষণ পর আরেক গুঁতা। হুজুর উঠে দাঁড়ালেন। এরপর তিনি। আর বাসায় আসেন নি। তবে আমি কিন্তু কোরানপাঠ শিখেছি। মার কাছে শিখেছি। মা বলেছেন আমার গলার স্বর মিষ্টি। আমার কোরানপাঠ শুনলে তার নাকি চোখে পানি আসে। মার কথা সত্যি হতে পারে। অতি অল্পতেই তাঁর চোখে পানি আসে।
সুসংবাদ! উপন্যাসের প্রথম কয়েক লাইন লিখে ফেলেছি–
আমাদের বাড়ির রেলিংয়ে একটা দাঁড়কাক এসে বসেছে। দাঁড়কাকটা সাইজে যথেষ্ট বড়। তার চোখ টকটকে লাল। কাকদের স্বভাব হচ্ছে অকারণে কা কা করে। এই কাকটা সে রকম না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের বাসা দেখছে। কাকা করার ক্ষমতা মনে হয় তার নেই। মানুষের মধ্যে যেমন বোবা। আছে, কাকদের মধ্যেও থাকতে পারে।
আমার ছোটভাই রুবেল মুখে ভরর ভরর শব্দ করে তার গাড়ি নিয়ে রেলিংয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, অ্যাক্সিডেন্ট। দাঁড়কাকটার উড়ে যাওয়ার কথা, সে উড়ে গেল না। তার স্বরে ডেকে উঠল, কা কা। এতে ভয় পেয়ে রুবেল বিকট শব্দে কেঁদে উঠল।
আমি আরও কিছুটা লিখতাম, এর মধ্যে মুখ প্যাঁচার মতো করে বাবা কাঁচাবাজার থেকে ফিরলেন। তিনি একগাদা বাজার করেছিলেন। একটা হাঁস কিনেছিলেন। দাম দেওয়ার সময় হঠাৎ হাঁসটা হাত থেকে ছুটে গেল। বাবা বাজার ফেলে হাঁস ধরতে গেলেন। হাঁস ধরতে পারলেন না। বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এসে দেখেন তার বাজারের ব্যাগ নেই। মানুষের আম যায় ছালা যায়, বাবার হাঁস গেছে বাজার গেছে। এটা কি নতুন বাগধারা হতে পারে না? আহসান সাহেব বলেছেন, লেখকদের নতুন নতুন শব্দ তৈরি করতে হয়। বাগধারা তৈরি করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ অনেক নতুন শব্দ বাংলা ভাষাকে দিয়েছেন। যেমন– বাগানবিলাস, উদয়পদ্ম, নীলমণিলতা।