উপন্যাস লেখার বিষয়ে আমি প্রতিমার সঙ্গে আলাপ করেছি। সে খুব উৎসাহী। আমাকে বলল, শুরুতে একটা সেক্স সিন দিয়ে দে। তাহলে পাবলিক খাবে।
আমি বললাম, সেক্স সিন আমি লিখতে পারব না।
প্রতিমা বলল, আমি লিখে দেব। যে পড়বে সে-ই ট্যারা হয়ে যাবে।
আহসান সাহেবের সঙ্গে আমি প্রতিমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। এক ছুটির দিনে প্রতিমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
প্রতিমা তাকে দেখে ভক্তি-শ্রদ্ধায় গলে যাওয়ার মতো ভাব করল। একেবারে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম।
আমি বললাম, এর নাম প্রতিমা। আমার প্রিয় বন্ধু। আপনার কথা অনেক। বলেছি তো, সে আপনাকে দেখতে এসেছে।
আহসান সাহেব প্রতিমার মাথায় হাত রেখে বললেন, কেমন আছ গো মা?
আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, আহসান সাহেব কখনো আমাকে মা ডাকেন না! কোনো পুরুষ যদি কোনো মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, তাকে সে কখনো মা ডাকবে না। ইহা সত্য, ইহা সত্য, ইহা সত্য।
আজ শুক্রবার
আজ শুক্রবার। সকাল আটটা বাইশ। আমি উপন্যাস নিয়ে বসেছি। উপন্যাসের প্রথম পাতাটা লিখব। আহসান সাহেব বলেছেন, প্রথম পাতা লেখাই কঠিন। কোনোরকমে প্রথম পাতা লেখার পর কলমের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যকারও হাতে। তখন আর লিখতে সমস্যা হয় না।
আমি বললাম, অন্যকারও হাতে মানে কী? অন্যকেউটা কে?
আহসান সাহেব বললেন, লেখকরা কেউই পরিষ্কার করে কিছু বলেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্যকেউটা হলো তার জীবনদেবতা। পুশকিন বলেছেন, অন্যকেউটা তার অদৃশ্য বন্ধু।
জ্ঞানের কথা বাদ। লেখা শুরুর আগে বাসার পরিবেশ বর্ণনা করি। আহসান সাহেব বলেছেন, যে পরিবেশে লেখা হয়, সেই পরিবেশ লেখাতে ছাপ ফেলে। বাসার পরিবেশ হচ্ছে–বাবা কাঁচাবাজারে গেছেন। শুক্রবারে তিনি সাপ্তাহিক বাজার করেন। এই দিন দুপুরে বাসায় ভালো রান্না হয়। খিচুড়ি-মাংস কিংবা মোরগপোলাও। গত সপ্তাহে মোরগপোলাও হয়েছে, আজ মনে হয় খিচুড়ি-মাংস হবে। খিচুড়ি আমার অপছন্দ। ডালমাখা ভাত যা, খিচুড়িও তা। আমার অপছন্দের কথা ছোটবেলায় বলতাম, এখন আর বলি না। অখাদ্য খিচুড়ি সোনামুখ করে খেয়ে ফেলি।
মা ব্যস্ত আছেন দেয়ালের ঝুল পরিষ্কারে। সকিনা (আমাদের কাজের মেয়ে) লম্বা লাঠির মাথায় ঝাড়ু বেঁধে ঘরের ঝুল পরিষ্কার করছে এবং কিছুক্ষণ পরপর খিকখিক করে হাসছে। সকিনার হাসার জন্যে কোনো কারণ লাগে না। যে কোনো কিছুতেই সে হাসতে পারে। হাসির কারণে একবার তার চাকরি নট হয়ে গিয়েছিল। আর কোনো কাজের মেয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে বাবা পাঁচ দিনের মাথায় নিজে আগারগাঁওয়ের বিএনপি বস্তি থেকে তাকে নিয়ে এসেছিলেন। ঘটনাটা বলে নেই।
বড় মামা বেড়াতে এসেছেন। তিনি আইডিয়েল কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক। অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। বেশিরভাগ সময় উপদেশমূলক জ্ঞানের কথা বলেন। আমি তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ দেখা হলেই তিনি প্রশ্ন করে বসবেন। না পারলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে বলবেন, হেসে খেলে জীবন পার করলে তো চলবে না। একটু সিরিয়াস হও। Young lady, life is not a bed of roses. এটা সব সময় মনে রাখবে।
ওই দিনের ঘটনা হচ্ছেবড় মামা এসেছেন। তাঁর পছন্দের ইজিচেয়ারে বসেছেন। গম্ভীর গলায় ডাকলেন, লিপি মা কোথায়? আমি বেজার মুখে তার সামনে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, তুরস্কের কামাল আতার্তুক সম্বন্ধে কী জানো বলো।
আমি বললাম, কিছুই জানি না মামা।
কিছুই জানো না?
জি-না।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল যে আতাতুর্ককে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন তার কয়েক লাইন বলতে পারবে?
আমি বললাম, না।
বড় মামা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই সময় সকিনা চায়ের কাপ নিয়ে এল। সে বড় মামার হাতে চায়ের কাপ দিতে যাচ্ছে, তখন বড় মামা বেশ শব্দ করে … দিলেন। কী দিলেন তা কি বোঝা যাচ্ছে? ইংরেজিতে বলে Fart। শব্দটা করে বড় মামা মুষড়ে পড়লেন।
সকিনা বাড়ি কাঁপিয়ে হেসে ফেলে হাতের চায়ের কাপ ফেলে দিল। গরম চা পড়ল মামার পায়ে। করেছিস কী!–বলে মামা একটা চিৎকার দিলেন। মা রান্নাঘর থেকে কী হয়েছে? কী হয়েছে? বলে ছুটে এলেন।
আমি খুব শান্ত মুখে বললাম, কিছু হয় নি মা। বড় মামা একটা পাদ দিয়েছেন। এই যা, শব্দটা বলেই ফেললাম! তবে মূল উপন্যাসে আমি এই ধরনের শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করব না। মূল উপন্যাসে এই ঘটনা থাকলে আমি লিখব, কিছু হয় নি মা। বড় মামা শব্দ করে গ্যাস ছেড়েছেন। আচ্ছা এই প্রসঙ্গ থাক। আমি উপন্যাস লেখার সময় বাসার পরিস্থিতি বর্ণনা আগে শেষ করি।
আমার ছোটভাই রুবেল বসার ঘরে গাড়ি চালাচ্ছে। তার বয়স নভেম্বরে চার হবে। সে ভয়ঙ্কর জেদি। বেশির ভাগ সময় গাড়িটায় বসে দুই পায়ে ভর দিয়ে গাড়ি চালায়। মুখে ভরর ভরর শব্দ করে। কিছুক্ষণ পরপর সোফায় বা দেয়ালে ইচ্ছা করে গাড়ি ধাক্কা লাগিয়ে বলে অ্যাক্সিডেন্ট। গাড়িটা বড় মামা তাকে তৃতীয় জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন। এই গাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে, এর পেছনের ডালা খোলা যায়। রুবেল অনেক কিছু এখানে লুকিয়ে রাখে। বাসায় যখন কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন রুবেলের গাড়ির ডালা খুললে সেটা পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত যেসব জিনিস পাওয়া গেছে তা হলো–