তোমাদের টেকেরঘাট অপারেশনের গল্পটা বলো তো।
সত্যি শুনতে চাও?
হুঁ। চাই।
গল্প তো শুনতে চাও না?
এখন চাই।
অপারেশন আসলে টেকেরঘাটে হয় নি। হয়েছে, জলকলসে।
ও আচ্ছা।
আমি কোন সেক্টরে ছিলাম তা তো জানো?
জানি। পাঁচ নম্বর সেক্টরে।
ঘটনা হলো কী, ভোরবেলায় সালেহ চৌধুরী সাহেব হঠাৎ বললেন, সবাই তৈরি হও। লঞ্চে ওঠো। লঞ্চের নামটা কি আগে বলেছি?
বলেছ। লঞ্চের নাম পাখি।
বাবা গল্প শুরু করলেন। আমি এখন আর তার কথা শুনছি না। অন্যকিছু ভাবছি। এই কাজটা আমি খুব ভালো পারি।
ক্লাসে আপারা যখন বক্তৃতা শুরু করেন, আমি অন্য কথা ভাবি।
এখন রিকশায় একই ব্যাপার ঘটছে। বাবা আইসক্রিমের কাঠি হাতে নিয়ে উত্তেজিত গলায় কথা বলে যাচ্ছেন, আর আমি ভাবছি প্রতিমার কথা।
প্রতিমা নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এই প্রজেক্টে আমাদের অংক আপাকে মাসে দুটা করে উড়ো চিঠি ছাড়া হচ্ছে। আমাদের অংক আপার চেহারা রাক্ষসীদের মতো। মুখভর্তি হলুদ চোখা চোখা দাঁত। বয়স চল্লিশের ওপরে। এখনো বিয়ে হয় নি। এই রাক্ষসীকে কে বিয়ে করবে!
অংক আপা স্কুলে সেজেগুজে আসেন। ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক দেন। গ্রামের মেয়েদের মতো গালে রুজ মেখে গাল লাল করেন। কী কুৎসিত যে তাঁকে দেখায়! আমার ধারণা সাজগোজের পর তিনি আয়নায় নিজেকে দেখেন না। দেখলে কখনোই সাজতেন না।
অংক আপাকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তার নমুনা (হুবহু হবে না। একবার মাত্র পড়েছি। প্রতিমা চিঠি পাঠিয়েছে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে।)–
ওগো আমার ময়না সোনা। লুতু লুতু পুতু পুতু।
তুমি যে কমলা আর বেগুনি ফুলের ছাপের শাড়ি পরে স্কুলে এসেছ, দূর থেকে দেখে আমি মোহিত হয়েছি। কী সুন্দর যে তোমাকে লাগছে চাঁদ সোনা! লুতু লুতুপুতু পুতু।.. .
আচ্ছা ভালো কথা, তোমার ডান স্তনটা কি বাঁয়ের চেয়ে বড়? আমার সে রকমই মনে হয়। তুমি ডান দিকে সামান্য ঝুঁকে হাঁট। ডান স্তনের অতিরিক্ত ভারেই কি এই অবস্থা?
চিঠির কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। বাবা অবাক হয়ে বললেন, হাসছ কেন? আমি তো হাসির কোনো কথা বলি নাই। আমাদের একজন সহযোদ্ধা পেটে গুলি খেয়েছে। এখন মরে তখন মরে অবস্থা। এই কথা শুনে হাসির কী আছে বুঝলাম না।
আমি বললাম, বাবা সরি।
বাবা বললেন, সরি পরে, আগে বলো তুমি হেসেছ কেন? চুপ করে থাকলে হবে না। জবাব দিতে হবে। এমন কি হতে পারে যে, আমি কী বলছি তা তুমি শুনছ না। অন্য কিছু ভাবছ?
হতে পারে, তবে তোমার প্রতিটি কথা আমি শুনেছি।
বলো দেখি, টেকেরঘাট সাব সেক্টরে আমাদের উপদেষ্টার নাম কী?
আমি বললাম, মেজর জগজিৎ সিং বাথ।
বাবার চেহারা কোমল হয়ে গেল। তিনি বললেন, গুড গার্ল।
বাবার কথা সত্যি না। আমি গুড গার্ল না। আমি ব্যাড গার্ল। কেমন ব্যাড গার্ল উদাহরণ দেব? আচ্ছা দেই।
একজন ব্যাড গার্লের লক্ষণ হচ্ছে, সে তার খুব কাছের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। এই যে বাবার সঙ্গে করলাম। মার সঙ্গে তো সব সময় করছি। সবচেয়ে বেশি আহসান সাহেবের সঙ্গে। দাবা খেলা নিয়ে প্রতারণা। আহসান। সাহেবের ধারণা তিনি খুব ভালো দাবা খেলেন। আসলে তা না। আমার সঙ্গে জেতার তার কোনোই সম্ভাবনা নেই, অথচ আমি ইচ্ছা করে হেরে গিয়ে তাঁকে আনন্দ দেই। খেলায় জিতে তিনি জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা বলেন। এইসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। তার জ্ঞানী কথার নমুনা—
লিপি, তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি খুব মন খারাপ করেছ। ফুটবল খেলায় হেরে যাওয়ার অর্থ শক্তির কাছে হার। দাবায় হার মানে বুদ্ধির কাছে হার। মন খারাপ হবেই। এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
আমি প্রতিবারই বলি, আপনার কাছে তো আমি হারবই।
তিনি বলেন, আগেই হার স্বীকার করে থাকবে না। চেষ্টা করবে। তোমার Opening খারাপ না। End game খারাপ। দাবার মূল খেলা হচ্ছে end game. কিছু কৌশল আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। ঠিক আছে?
জি। ঠিক আছে।
ববি ফিসারের নাম শুনেছ?
জি-না।
আমেরিকান দাবা খেলোয়াড়। Legand. দাবার জগতে হুলুস্থুল করে গেছেন। End game এর ওপর লেখা তার একটা বই আছে। আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়বে।
আচ্ছা।
এখন তোমাকে শেখাব Fools Mate। কী করে বোকা খেলোয়াড়কে তিন দানে হারানো যায়।
তিনি আমাকে Fools Mate শেখালেন। আমি মনে মনে হাসলাম। আমি জানি, তিন দানে তাকে হারানো যাবে না, কিন্তু কুড়ি দানে অবশ্যই যাবে।
দাবার গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে আমি এই পর্যন্ত তিনবার খেলেছি। প্রথম খেলায় তিনি জিতেছেন, বাকি দুটায় ড্র হয়েছে। প্রথমটায় উনি জিততে পারতেন না। একজন গ্র্যান্ড মাস্টারের সঙ্গে খেলছি, এই মানসিক উত্তেজনাই আমার কাল হয়েছে।
দাবা খেলা থেকে আমার শিক্ষা হচ্ছে, মানসিক উত্তেজনা একপাশে সরিয়ে খেলতে হবে। দৃষ্টি থাকবে বোর্ডের সেন্টারের দিকে। সেন্টারের দখল যেন কখনো হাতছাড়া না হয়। ক্যাসলিং করে রাজা লুকানো যাবে না। যুদ্ধের মাঠে। লুকানোর প্রশ্ন ওঠে না।
আমার উপন্যাসের নায়িকা হবে একজন দাবাড়ু। দাবার প্রতিভা সে কখনোই প্রকাশ করবে না। সব প্রতিভা প্রকাশ করতে নেই।
আমার উপন্যাসে নায়ক একজন, তবে নায়িকা থাকবে দুজন। একজন। আমি, অন্যজন প্রতিমা। আমি নায়ককে আকর্ষণ করব বুদ্ধি দিয়ে, প্রতিমা করবে শরীর দিয়ে।