বাবা তার বন্ধু আহসান সাহেব সম্পর্কে বলেন, বিস্তর পড়াশোনা করেছে। তাতে লাভ কী? যা হয়েছে এর নাম বুকিশ নলেজ। বুকিশ নলেজ কোনো কাজে আসে না।
আমার মাঝে মাঝে বাবাকে বলতে ইচ্ছা করে, তোমার নলেজ কোন লাইনে? তোমার নলেজ, কীভাবে কাজে এসেছে?
মেয়ে হয়ে বাবাকে এইসব কথা বলা যায় না। সন্তান ও পিতার সম্পর্ক নিয়ে বাবা মাঝে মাঝে হাদিস থেকে উদাহরণও দেন। সেদিন বললেন, আল্লাহ যদি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করার অনুমতি দিতেন সেটা হতো, সন্তান। পিতাকে সেজদা করবে। এখন বুঝে দেখো পিতার মর্যাদা। মাতার চেয়ে পিতা টেন টাইমস ওপরে।
হাদিস জানা ভালো কোনো আলেম পাওয়া গেলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম– এই হাদিস সঠিক কি না। বাবা প্রায়ই হাদিস আওড়ান। আমার ধারণা, বেশিরভাগই বানানো। তাকে আমি কখনো হাদিস-কোরান পড়তে দেখি নি। বাবার বলা হাদিসগুলি আসলেই যাচাই করা দরকার।
আমাদের স্কুলের যে হুজুর আপা আছেন তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো না। সম্পর্ক ভালো থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম। হুজুর আপার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে কীভাবে সেটা বলি। গত রোজার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
আপা! জ্বিনরা কি খাবার খায়?
আপা বললেন, খায়। তারা মানুষের মতোই এক ধরনের প্রাণী। তাদেরও . . খাদ্যের প্রয়োজন আছে।
আমি বললাম, তারা কী খাবার খায়?
আপা বললেন, মৃত পশুর হাড়, কয়লা, এইসব তাদের খাদ্য।
আমি বললাম, আপা, জ্বিনদের মধ্যে মুসলমান আছে?
আপা বললেন, আছে। আমাদের নবিজি (সঃ)-এর কাছে অনেক জ্বিন ইসলাম গ্রহণ করেছে।
আমি বললাম, তাহলে তারা রোজা নিশ্চয় রাখে?
আপা বিরক্ত হয়ে বললেন, এইসব জানতে চাচ্ছ কেন?
আমি মুখ শুকনা করে বললাম, আপা, আমি একটা উপন্যাস লিখছি। সেখানে ধার্মিক জ্বিনের একটি চরিত্র আছে। এইজন্য জানতে চাচ্ছি।
হুজুর আপা হেড মিসট্রেসের কাছে আমার নামে নালিশ করলেন। হেড মিসট্রেস আমাকে ডেকে পাঠালেন। কঠিন গলায় বললেন, লিপি, তোমার সমস্যা কী?
আমি বললাম, আপা, আমার কোনো সমস্যা নেই।
তুমি নাকি জ্বিনদের নিয়ে উপন্যাস লিখছ?
জ্বিনদের নিয়ে কিছু লিখছি না। তাদের বিষয়ে কিছু জানি না। আমার উপন্যাসে একজন ধার্মিক জ্বিনের চরিত্র আছে। এইজন্য জানতে চাচ্ছিলাম।
হেড মিসট্রেস বললেন, তোমার নামে অনেক কমপ্লেন আছে। তোমার বাবাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে। আগামী সোমবার চারটার পর আসতে বলবে।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
খারাপ মেয়ে আমি স্কুলে রাখব না। টিসি দিয়ে বের করে দেব। বুঝেছ? জি আপা।
আপা বললেন, বাথরুমে অতি নোংরা কিছু ছবি আঁকা হয়েছে। সেগুলি কি তোমার আঁকা?
আমি বললাম, জি-না। তবে কে এঁকেছে আমি জানি। (আসলেই জানি। ছবিগুলি এঁকেছে প্রতিমা।)
আপা চোখ মুখ সরু করে বললেন, বলো কে এঁকেছে?
আমি বললাম, কোনো এক দুষ্ট জ্বিন এঁকেছে। দুষ্ট জ্বিনরা এই ধরনের কাজ করে।
আপা বললেন, সোমবার অবশ্যই তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে।
.
সোমবারে বাবা হেড মিসট্রেসের সঙ্গে দেখা করলেন। বেশ অনেকক্ষণ থাকলেন। আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। যদি আমার ডাক পড়ে! ডাক পড়ল না। বাবা মুখ শুকনা করে বের হলেন। আমরা দুজন রিকশা নিয়ে ফিরছি। বাবা _ বললেন, তুমি নাকি জ্বিন নিয়ে বই লিখছ?
আমি বললাম, জ্বিন নিয়ে বই কি লিখব? ওদের বিষয়ে কি জানি?
বাবা বললেন, সেটাও তো কথা। মা শোনো, শিক্ষকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের মর্যাদা। এই বিষয়েও নবিজির একটা হাদিস আছে।
আমি বললাম, হাদিস শুনতে ইচ্ছে করছে না। আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে, আইসক্রিম কিনে দাও। দুটা ললি আইসক্রিম কিনে আনো। দশ টাকা দাম।
রাস্তার মাঝখানে আইসক্রিম কোথায় পাব?
ওই যে আইসক্রিমের গাড়ি। দুটা কিনবে। আমি দুই হাতে দুটা আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে যাব।
বাবা বললেন, হেড মিসট্রেস ঠিকই বলেছেন, তোমার মাথায় সমস্যা আছে।
বাবা আইসক্রিম কিনে আনলেন। আমি একটা তার হাতে দিয়ে বললাম, একটা তুমি খাবে আরেকটা আমি খাব। বাবা মেয়ে দুজন আইসক্রিম খেতে খেতে যাব।
আমি যা ভেবেছিলাম তা-ই হয়েছে। বাবা আইসক্রিম খেতে খেতে যাচ্ছেন। তার চোখে পানি এসে গেছে। আমার উপন্যাসে এরকম একটা দৃশ্য থাকবে। একটা না, অনেকগুলি দৃশ্যই থাকবে।
বাবা শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। আমি বললাম, কাঁদছ কেন?
বাবা বললেন, কাঁদব কী জন্যে? চোখ উঠবে। চোখ ওঠার আগে আগে চোখ, দিয়ে পানি পড়ে।
ও আচ্ছা।
বাবা বললেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সবার চোখ উঠেছিল। এই রোগের তখন নামই হয়ে গেল, জয় বাংলা রোগ।
আমি বললাম, বাবা! তুমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প ফাঁদার চেষ্টা করছ। রিকশায় যেতে যেতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব না।
বাবা কিছু বললেন না। আমি লিখতে ভুলে গেছি–বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। সিলেট এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তাদের কমান্ডার ছিলেন সালেহ চৌধুরী। বাবার প্রধান আনন্দ মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা। এই আনন্দ তিনি তেমন পান না। কারণ আমরা তাঁকে গল্প শুরু করতে দেই না। শুরুতেই থামিয়ে দেই।
বারার আইসক্রিম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তার হাতে কাঠি রয়ে গেছে। বাচ্চাদের মতো হাতে কাঠি নিয়ে বসে আছেন।
বাবা!
হুঁ।