ওপাশ : (মনে হচ্ছে টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। কারণ আহসান সাহেব কান থেকে টেলিফোন নামিয়ে বিরক্তমুখে টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন।)
এই সময় আমি স্টেজে ঢুকে পড়লাম। অর্থাৎ উনার কাছে গেলাম। আমি মাঝে মাঝে এই ধরনের বাক্য লিখব। শুরুতে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে।
আহসান সাহেব আমাকে দেখে বললেন, হ্যালো!
আমি জবাব না দিয়ে হাসলাম। হাসার সময় মাথা সামান্য কাত করে চিন. ডাউন করে রাখলাম। মেয়েদের এই অবস্থায় সবচেয়ে সুন্দর লাগে। আমি নিজে নিজে এই তথ্য বের করি নি। ইন্ডিয়ান একটা ম্যাগাজিনে পড়েছি। ম্যাগাজিনের নাম সানন্দা। সেখানে ছবি তোলার সময় কী করতে হবে তাও লেখা আছে। ছবি তোলার সময় চীজ বলা যাবে না। জিভের আগা দিয়ে তালু ছুঁয়ে রাখতে হয়। জিভের আগা দিয়ে তালু ছুঁয়ে রাখলে মুখের চামড়া রিলাক্সড হয়। ছবি ভালো আসে। আমি দুভাবেই ছবি তুলে দেখেছি, কোনো বেশকম হয় না। তবে একটায় গালের চামড়া সামান্য ফুলে থাকে। অন্যটায় থাকে না।
আহসান সাহেব বললেন, তারপরে লিপি কী সমস্যা?
না, আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই।
আমার কাছে এসেছ? হ্যাঁ। বলো কী করতে পারি? আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে পারেন।
এখন সম্ভব না। আমি একটি জরুরি টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করছি। কাজেই গেট লস্ট, অর্থাৎ হারিয়ে যাও।
উনার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল। চোখে পানি এলে চট করে মুখ সরিয়ে নিতে হয় না। তাতে চোখে আরও বেশি করে পানি জমে। আমি একটা টেকনিক বের করেছি, এই টেকনিকে চোখে জমে থাকা পানি সঙ্গে
সঙ্গে শুকিয়ে যায়। কেউ বুঝতেই পারে না যে চোখে পানি এসেছিল। এই টেকনিক ব্যবহার করে আমি চোখের পানি শুকিয়ে ফেলে বললাম, আমি এসেছি :
জবা ফুলের ইংরেজি কী জানতে। ইংরেজিটা বললেই চলে যাব।
জবা ফুলের ইংরেজি তো তোমাকে একবার বলেছি। ভুলে গেছি। বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারি দেখে নাও। তাহলে আর ভুলবে না।
এই সময় তার মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল। মনে হয় জরুরি টেলিফোন, চলে এসেছে। আমি মুখ ভোঁতা করে চলে এলাম। তিনি টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত। ছিলেন বলে আমার ভোতা মুখ দেখতে পেলেন না।
আমি বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারি নিয়ে বসেছি। জবা ফুলের ইংরেজি নাম খুঁজছি। জবা ফুলের ইংরেজি আমি জানি–চায়না রোজ।
তারপরেও ডিকশনারি ঘাটছি, কারণ আহসান সাহেব আমাকে ডিকশনারি দেখতে বলেছেন। তিনি আমার গুরু। তিনি যা বলবেন তা-ই আমি করব। তিনি যদি বলেন, লিপি, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ো তো।
আমি বলব, জি আচ্ছা স্যার। এক্ষুনি লাফ দিচ্ছি। আপনি শুধু বলবেন ওয়ান টু থ্রি। থ্রি বললেই ঝপ দেব।
আমাকে ডিকশনারি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে দেখে বাবা বললেন, কী করছিস? আমি বললাম, ডিকশনারি দেখছি। জবা ফুলের ইংরেজি কী দেখছি।
বাবা আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। এর অর্থ জবা ফুলের ইংরেজি তিনি জানেন না। বাবাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। জবা.. ফুলের ইংরেজি তিনি যদি জানতেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, জবা বাংলাদেশের অতি কমন এক ফুল। এর ইংরেজি হলো, চায়না রোজ। তুমি এটা। জানো না, আশ্চর্য! স্কুলে তোমাদের কী শেখায়? ক্লাস ফাঁইভ-সিক্সের একটা মেয়ে যা জানে, তুমি তো তাও জানো না।
আমার ডিকশনারি দেখা শেষ হলো।
বাবা বললেন, পেয়েছ?
আমি বললাম, হুঁ, চায়না রোজ।
বাবা বললেন, জবা বাংলাদেশের অতি সাধারণ একটা ফুল। তুমি এর . ইংরেজি জানো না শুনে দুঃখ পেলাম। চায়না রোজ অর্থাৎ নাক চ্যাপা চিনাদের গোলাপ। একটা খাতায় দশবার লেখো চায়না রোজ। যাতে আর ভুলে না যাও।
আমি খাতা নিয়ে দশবার চায়না রোজ না লিখে লিখলাম–বাবা নিজেকে যতটা চালাক ভাবেন তিনি তত চালাক না। জবা ফুলের ইংরেজি তিনি জানতেন না। ভাব করেছেন যেন জানেন।
বাবা বললেন, লিখেছ?
আমি বললাম, হুঁ।
বাবা বললেন, এক মিনিটে লেখা হয়ে গেল? কী লিখেছ দেখাও। যদি দেখি দশবারের কম তাহলে খবর আছে।
আমি গম্ভীর মুখে বাবাকে খাতা দেখালাম। তিনি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকালেন। চিৎকার চেঁচামেচি করলেন না। তিনি খাতার পাতা উল্টাতে : থাকলেন। আমি ছাদে চলে গেলাম। জবা ফুলের ইংরেজি শিখেছি, এটা আহসান সাহেবকে জানানো দরকার।
আহসান সাহেব বললেন, ডিকশনারি দেখেছ?
আমি বললাম, হুঁ। চায়না রোজ।
আহসান সাহেব বললেন, জবার আরেকটা নাম আছে। Shoe flower. অর্থাৎ জুতা ফুল। জবা ফুল জুতা কালো করার কালিতে ব্যবহার হয় বলে এই নাম। মনে থাকবে?
থাকবে।
জবার বোটানিকেল নাম হলো Hibiscus rosa. পৃথিবীর পাঁচটি দেশের জাতীয় ফুল জবা। এই মুহূর্তে আমার দুটা দেশের নাম মনে পড়ছে। একটা হলো মালয়েশিয়া, আরেকটা উত্তর কোরিয়া।
এই হলো আহসান সাহেব। হেন জিনিস নাই যে ইনি জানেন না। তাঁর বিপরীত মেরুতে বাবার অবস্থান। তিনি কিছুই জানেন না। কোনো কিছু জানার ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। বাবার সঙ্গে আহসান সাহেবের বন্ধুত্ব কীভাবে। হয়েছে কে জানে! আহসান সাহেব দিনরাত বই পড়েন। বাবা সব মিলিয়ে দুটা বই পড়েছেন—শরৎচন্দ্রের দেবদাস আর যাযাবরের দৃষ্টিপাত। তিনি কথায় কথায় এই দুটা বইয়ের কথা বলেন। দৃষ্টিপাত থেকে কোটেশান দেন। যেমন, বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।