চারটার সময় স্কুল ছুটি হয়েছে, আমি প্রতিমার সঙ্গে গেট দিয়ে বের হয়ে দেখি আহসান সাহেবের ড্রাইভার। সে বলল, স্যার, আপনাকে নিতে এসেছেন। গাড়িতে বসে আছেন।
আমি গাড়ির কাছে গেলাম।
আহসান সাহেব বললেন, সাভারের বাগানবাড়িতে সেনচুরিয়ান গাছে ফুল ফুটেছে। অসাধারণ দৃশ্য। দেখতে যাবে?
আমি কিছু বলার আগেই প্রতিমা বলল, আমি যাব। কাকু, আমি যাব।
আমি বললাম, আপনি প্রতিমাকে নিয়ে যান। প্রতিমা ফুল খুব পছন্দ করে।
আহসান সাহেব বললেন, তুমি যাবে না?
আমি বললাম, না। আমি ফুল পছন্দ করি না।
বলেই বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আহসান সাহেব ডাকলেন, লিপি। এই লিপি।
আমি ফিরেও তাকালাম না।
সন্ধ্যার পরপর আহসান সাহেব আমাদের বাসায় উপস্থিত। এই কাজ তিনি কখনো করেন না। বাবার সঙ্গে তার নাকি জরুরি আলাপ। আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললাম তিনি কী জন্যে এসেছেন। তিনি বাবার সঙ্গে কথা বলতে আসেন নি। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন, মাধ্যম হলেন বাবা। তিনি ধরে নিয়েছেন তাদের কথাবার্তা আমি আড়াল থেকে শুনব।
অন্যের কথা আড়াল থেকে শোনা অপরাধ, শুধু লেখকদের ক্ষেত্রে এটা অপরাধ না। কথাটা মার্কিন লেখক মার্ক টুয়েনের। আমাকে বলেছেন আহসান সাহেব। লেখকদের প্রধান কাজ শুনে যাওয়া। প্রকাশ্য কথা অপ্রকাশ্য কথা–সব শোনা। আমি তা-ই করলাম। তাদের কথাবার্তার সময় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আহসান সাহেব : আজ সকালের ঘটনাটার জন্য আমি লজ্জিত। টেনশনে আছি তো, টেনশনে মাথা এলোমেলো হয়ে আছে।
বাবা : কোন ঘটনার কথা বলছ?
আহসান : তোমাকে বেয়াকুফ বলেছি।
বাবা : বেয়াকুফকে বেয়াকুফ বলার মধ্যে দোষের কিছু না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের কমান্ডার আমাকে সব সময় বলতেন বুরবাক। আচ্ছা ওই প্রসঙ্গ থাক। তোমার টেনশন কী নিয়ে সেটা বলো।
আহসান : বিয়ে করব কি করব না, এই নিয়ে টেনশন। তুমি তো জানো, আমার আগের বিয়েটা ওয়ার্ক আউট করে নি। যার প্রথম বিয়ে ওয়ার্ক আউট করে না, তার দ্বিতীয়টাও করে না। তবে তৃতীয়টা করে।
বাবা : জানতাম না তো!
আহসান : এই স্ট্যাটিসটিকস আমেরিকানরা বের করেছে। তিন বিয়ে চার বিয়ে তো ওদের কাছে ডালভাত। ইছামতি উপন্যাসে বিভূতিভূষণ এক যুবককে তিন বোনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন এবং যুবক অসম্ভব সুখী হয়েছিল। এই গল্পটি আহসান সাহেব আমাকে শোনানোর জন্য বলেছেন। তিনি ইছামতি উপন্যাসটা আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন।
বাবা : তিন বোন বিয়ে করে সুখী? ভালো তো। হা হা হা।
[বাবা অকারণে হাসছেন। হাসির কিছু ঘটে নি। তিনি হাসছেন প্রমাণ করার জন্যে যে, আহসান সাহেবের কথা শুনে তিনি মজা পাচ্ছেন। ঘরজামাই যেমন শ্বশুরের মান রেখে চলে, একজন আশ্রিতও আশ্রয়দাতার মান রেখে চলে।]
বাবা : আমার মতে তোমার উচিত একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করা। শেষ বয়সে সেবাযত্নের প্রয়োজন আছে।
আহসান : আমার সেবাযত্নের জন্যে স্ত্রী প্রয়োজন নেই। আমার কাছে স্ত্রী হলো কম্পেনিয়ন। সাথী।
বাবা : ও আচ্ছা সাথী। অবশ্যই সাথী।
[বাবা জ্ঞানীর মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, যেন সাথী বিষয়টা তিনি বুঝে ফেলেছেন।]
আহসান : ডাকাতের সঙ্গে তার যে বন্ধু ডাকাতি করতে যাচ্ছে সেও কিন্তু ডাকাতের সাথী।
বাবা : আরে তাই তো! Valid Point। বিষয়টা সেইভাবে আগে চিন্তা করি নাই। তুমি বলায় সব ক্লিয়ার হয়ে গেল।
[বাবার কাছে কিছুই ক্লিয়ার হয় নি। সব জট পাকিয়ে আছে। বন্ধুকে খুশি করার চেষ্টায় আছেন।]
আহসান : এক কাপ চা খাব। লিপিকে চা দিতে বলো। চায়ে আমি কতটুকু চিনি খাই লিপি জানে।
আহসান সাহেব ভেবেছিলেন চা নিয়ে আমি ঢুকব। তিনি এই ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষা। এই ধরনের অপেক্ষার ভেতর দিয়ে আমি নিজেও গিয়েছি। আমার সব অপেক্ষা শেষ হয়েছে অবহেলায়। আমি চা বানিয়ে সকিনাকে দিয়ে পাঠালাম।
আহসান সাহেব চলে যাওয়ার পর বাবা আনন্দিত গলায় জানালেন, রাতে আহসান আজ আমাদের সঙ্গে খাবে। তার বাবুর্চি আসে নি।
আমি বাবাকে বললাম, খেতে এসে তিনি যদি আমার খোঁজ করেন তাহলে বলবে, আমি শুয়ে আছি। আমার জ্বর।
বাবা কপালে হাত দিয়ে বললেন, কপাল তো ঠান্ডা।
আমি বললাম, কিছু কিছু জ্বর চামড়ার ভেতরে থাকে। গায়ে হাত দিয়ে সেই জ্বর বোঝা যায় না।
বাবা বললেন, এই অদ্ভুত কথা তোমাকে কে বলেছে?
আমি বললাম, আহসান চাচু বলেছেন।
বাবা বললেন, তাহলে ঠিক আছে। তাকে আমি চিনি তো, সে ভুল কথা বলার মানুষই না।
আমি বললাম, উনি ভুল কথা বলার মানুষ না?
বাবা বললেন, No never.
আমি বললাম, তোমার বন্ধু তাহলে মহাজ্ঞানী?
বাবা বললেন, Yes.
তিনি উত্তেজিত হয়ে গেলে ইংরেজি বলেন। বেশির ভাগ সময় ভুলভাল ইংরেজি। একবার আমার ওপর রাগ করে বলেছিলেন, You girl very naughty.
আমি বললাম, ভুল ইংরেজি বলবে না বাবা।
বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললেন, কোথায় ভুল করলাম? ইংরেজির প্রফেসর এসেছে! আমাকে ইংরেজি শেখায়! থাপড়ানো দরকার।
উত্তেজনায় বাবার ইংরেজি আরও জড়িয়ে গেল। তিনি ক্রমাগত বলতে লাগলেন, 1 drop window you. এর অর্থ তিনি আমাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেবেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাবার ভুলভাল ইংরেজি শুনতে আমার ভালো লাগে। এই অদ্ভুত মানসিকতার কারণ কী কে জানে! আহসান সাহেবকে জিজ্ঞেস করা যায়। উনি নিশ্চয় জানেন।