মামা ঠিক করেছেন এই বাড়িতে থাকবেন না। তিনি কলাবাগানের এক হোটেলের সঙ্গে মাসকাবারি ব্যবস্থা করেছেন। হোটেলের নাম ব্লু হাউস।
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ভাইজান, সত্যি চলে যাবেন?
বড় মামা বললেন, এখনই তো যাচ্ছি না। বুধবার যাব। বুধবার থেকে হোটেল বুকিং নিয়েছি। মাঝে মধ্যে এসে এক দুই রাত থাকব।
মাঝে মধ্যে এসে এক দুই রাত থাকব বলার সময় চট করে মামা একবার সকিনার দিকে তাকালেন। বিষয়টা অন্য কেউ লক্ষ করল না। লক্ষ করার কথাও না। আমি লক্ষ করলাম।
বাবা বললেন, জিনিসপত্র কি সব নিয়ে যাবেন ভাইজান?
প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যাব। বাকি সব থাকবে। বড় ট্রাংকটা নিয়ে যাব। সেখানে কিছু জরুরি কাগজপত্র আছে।
বড় মামা জানেন না ট্রাংকে তাঁর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কিছুই নেই। সব আমি সরিয়ে ফেলেছি। চাবিওয়ালা বড় ট্রাংকের চাবি বানিয়ে দিয়েছে। সেই চাবি আমার পড়ার ড্রয়ারে লুকানো।
ট্রাংকে আমি একটা দলিল দেখে আনন্দ পেয়েছি। এক শ টাকার স্ট্যাম্পে মা লিখেছেন, জমিতে মায়ের যে অংশ তা তিনি বড় মামাকে লিখে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই বড় মামা মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এই দলিল করিয়েছেন। মা এত বোকা কেন বুঝলাম না। সাধারণত দেখা যায়, স্ত্রী বোকা হলে স্বামী চালাক হয়। আমার বাবা-মা দুজনই বোকা। বাবা বোকা হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে। তাঁর চিন্তা চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বাইরে কিছু নেই। তিনি যতটা বোকা তাঁর স্ত্রী ঠিক ততটাই বোকা। তাদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে নাম হতো বোকাবুকির সংসার।
বড় মামার দশতলা দালানের ব্যাপারটা এখন স্পষ্ট হয়েছে। ট্রাংকের বাকি কাগজ এখনো দেখা হয় নি। ধীরে ধীরে দেখব। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। যখন জানবেন তখন কী নাটক হয় কে জানে! নাটকটা দেখতে ইচ্ছে করছে। মার কাছে বড় মামা ও সকিনার বিষয়টা বলতে চাচ্ছি। আমি সকিনাকে ভোররাতে মামার ঘর থেকে বের হতে দেখেছি।
মা আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। সবচেয়ে ভালো হয় সকিনা যখন মামার ঘরে তখন হঠাৎ বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেওয়া।
বড় মামা বুধবারে চলে যাবেন। আজ রবিবার। হাতে দুদিন মাত্র আছে। এই দুদিনের ভেতর কি ঘটনা ঘটবে? হে আল্লাহপাক, যেন ঘটে।
.
আহসান সাহেব আমার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন। কয়েকবার খবর পাঠিয়েছেন যেন আমি দেখা করি। আমি দেখা করি নি। এই কিছুক্ষণ আগে বাবাকে দিয়ে স্লিপ পাঠিয়েছেন। মুখবন্ধ খাম বাবা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আহসান তোমাকে দিতে বলল। খাম খুলে দেখি ইংরেজিতে লেখা– need to talk to you.
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, কী লেখা?
আমি বললাম, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
বাবা বললেন, যাও কথা বলে আসো। না গেলে রাগ করবে। আহসানের মেজাজ কী কারণে জানি খুব খারাপ।
তোমাকে অপমান করেছেন, তাই না?
তুমি কীভাবে জানলে?
অনুমান করছি।
বাবা বললেন, তোমার অনেক বুদ্ধি। অনুমান ঠিক আছে।
আমি বললাম, তিনি সবার সামনে তোমাকে ইডিয়ট বলেছেন। তাই না?
বাবা ক্ষীণ গলায় বললেন, সবার সামনে না। ক্যাশিয়ার সাহেবের সামনে। ইডিয়টও বলে নাই। বলেছে বেয়াকুফ।
তুমি কী বললে?
আমি আবার কী বলব? আমি তো আর তাকে বেয়াকুফ বলতে পারি না। তবে মনে কষ্ট পেয়েছি।
আমি বললাম, বাবা, চাকরিটা ছেড়ে দিলে হয় না?
বাবা চমকে উঠলেন। আমি বললাম, তিনিই তোমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেবেন। কাজেই আগেভাগেই চাকরি ছেড়ে দেওয়া ভালো।
বাবা বললেন, চাকরি ছেড়ে দিলে থাকব কোথায়?
আমি বললাম, রাস্তায় থাকব। হিমু-পরিবার হয়ে যাব।
বাবা বললেন, হিমু-পরিবার আবার কী?
যে পরিবারের সব সদস্য শুধু পথে পথে হাঁটে, সেই পরিবারকে বলা হয় হিমু পরিবার।
বাবা হতাশ গলায় বললেন, তোমার কথা আগেও বুঝতে পারতাম না, এখনো পারি না।
আমি বললাম, তুমি যদি রবীন্দ্রনাথ হতে তাহলে এখন বলতে, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।
বাবার সবকিছু জলাঞ্জলির সময়ে এসে গেছে, তিনি বুঝতে পারছেন না।
.
আহসান সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। লিখে পাঠিয়েছেন—l need to talk to you. পরপর দুটা to, বাজে ইংলিশ। l need to talk লিখলেই হতো। কথা শোনার জন্যে আমি আহসান সাহেবের কাছে গেলাম না। স্লিপের উত্তর স্লিপ দিয়ে দিতে হয়, কাজেই আমিও একটা স্লিপ লিখে সকিনাকে দিয়ে পাঠালাম। সেখানে লেখা–
“রাক্রিমখ নাফনা
কুরেৎ সি ঝিনা। ৫৩০১ ফ্রেং।”
সাংকেতিক কোনো চিঠি না। হাবিজাবি লেখা, কিন্তু তিনি ভাববেন সাংকেতিক চিঠি। অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালাবেন। অর্থ উদ্ধার করতে পারবেন না। অতিবুদ্ধিমান হওয়ার কারণে হালও ছাড়বেন না। বিপদে অতিবুদ্ধিমানরাই পড়ে। সাধারণরা পড়ে না।
মামা অতিবুদ্ধিমান বলেই বিপদে পড়বেন। শিং মাছ যেমন ছাই দিয়ে ধরা হয়, মামাকেও আমি ছাই দিয়ে ধরব। ধরব বলা ঠিক হবে না, ধরে ফেলেছি। পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কে সাহায্য করবে? কে আবার? বোকা সকিনা।
সকিনা রে সখিনা।
তোর রঙ্গ দেখে বাঁচি না।
ধুর! ভুল বললাম, রঙ্গ সকিনার না–রঙ্গ আমার মামার। তার রঙ্গ দেখে আমি বাঁচি না। রঙ্গ অবশ্যি আহসান সাহেবও দেখাচ্ছেন। এবং আরও দেখাবেন।
আহসান সাহেবের সাম্প্রতিক রঙ্গের একটি ঘটনা বলি।