আমি বললাম, আপা! আমি এখন বাসায় যেতে পারব না। বাসায় এখন কেউ নাই। চারটার সময় আমাকে নিতে গাড়ি আসবে।
অংক মিস বললেন, তাহলে এক কাজ করো। কমনরুমে যাও। সোফায় শুয়ে থাকো। তোমাকে দেখে তো ভয় লাগছে, চোখ টকটকে লাল।
আমি কমনরুমের সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই নোংরা এক স্বপ্ন দেখলাম। আহসান সাহেব এবং আমি গাড়িতে করে যাচ্ছি। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। আমরা পেছনের সিটে। আমি তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। হঠাৎ তিনি বললেন…। না, এই স্বপ্নটা বলা যাবে না।
চারটায় স্কুল ছুটি হলো। আমি স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। পাঁচটা বাজল, সাড়ে পাঁচটা বাজল। ছটার সময় আহসান সাহেবের গাড়ি নিয়ে বাবা উপস্থিত। বাবা বললেন, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? স্কুল ছুটি হয়েছে। বাসায় যাবি না? তোর মা চিন্তায় অস্থির। তোর কী হয়েছে?
এই ঘটনার দুদিন পর আহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। আমি এমন ভাব করলাম যেন কিছুই হয় নি। আহসান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, লিপি, তোমার বয়স কত?
আমি বললাম, পনের।
তিনি বললেন, পনের বছর বয়েসী একটি মেয়ে কারও কথায় বেড়াতে চলে যাবে না। সে নিজেকে রক্ষা করবে। মনে থাকবে?
আমি বললাম, জি।
তিনি বললেন, ছাদে আজ টেলিস্কোপ ফিট করছি। মঙ্গল গ্রহ দেখা হবে। দেখতে চাও?
আমি বললাম, চাই।
মঙ্গল গ্রহের চাঁদ কয়টা বলো। তোমাকে আগে বলেছি।
দুটা।
নাম জানো?
না।
নাম শিখে রাখো। একটির নাম ডিমোস, আরেকটির নাম ফিবোস। মনে থাকবে?
থাকবে।
গুড গার্ল। তোমার বান্ধবী প্রতিমাকে খবর দাও। সেও দেখুক, আনন্দ পাবে। ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দাও।
আমি বললাম, যা দেখার আমি একা দেখব। কারও সঙ্গে শেয়ার করব না।
তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। মনে হচ্ছে তিনি খুব মজা পেয়েছেন।
তিনি আমাকে যার ভেতর দিয়ে নিয়েছেন, আমি তাঁকেও সেই গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব। আচারের বোতল আমার পায়ে পড়েছিল, কিন্তু পা কাটে নি। পা কাটার কথা বলেছি তাঁর রিঅ্যাকশান কী হয় তা দেখার জন্যে। তাঁর রিঅ্যাকশান দেখে খুশি হয়েছি।
ডেটল নিয়ে এসে আমাকে না দেখে তিনি কী করেছেন তা দেখতে পেলাম না। সামান্য আফসোস। সেই আফসোসও দূর হলো যখন বাবা বললেন, আচারের বোতল পড়ে তোমার নাকি পা কেটেছে?
আমি বললাম, হুঁ।
উনি তোমার জন্যে তুলা-ডেটল আনতে গেলেন, আর তুমি পালিয়ে চলে এলে? উনি টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এক্ষুনি যাও পা দেখিয়ে আসো।
আমি বললাম, যাব না।
বাবা বললেন, অবশ্যই যাবে। একজন কেউ মমতা দেখালে তার মূল্য দিতে হয়। এই বিষয়ে একটা সহি হাদিস আছে।
আমি বললাম, উনার কাছে যাচ্ছি। তোমাকে হাদিস কপচাতে হবে না।
আহসান সাহেব আমাকে দেখেই ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, তুমি কোথায় পালিয়ে গেলে?
আমি বললাম, ভয়ে পালিয়ে গেছি।
কিসের ভয়?
ডেটল দিতে গিয়ে যদি আপনি আমার পায়ে হাত দেন সেই ভয়ে।
তিনি একটু থতমত খেলেন। আমি বললাম, বাসায় এসে দেখি পা কাটে নি। আচারের লাল তেল রক্তের মতো দেখাচ্ছিল।
তোমার জন্মদিন উপলক্ষে তোমাকে একটা গিফট পাঠিয়েছিলাম। গিফট দেখে খুশি হয়েছ? গিফট পছন্দ হয়েছে?
আমি বললাম, প্যাকেট খুলি নি তো। তাই জানি না কী গিফট।
প্যাকেট খোল নি কেন?
বাসায় অনেক ঝামেলা হচ্ছে তো, এইজন্যে খোলা হয় নি।
আহসান সাহেব বললেন, তোমাদের বাসার অবস্থা কী?
আমি বললাম, গাইলানের ভয়ে সবাই অস্থির।
গাইলান কী?
খারাপ ধরনের জ্বিন। জ্বিনদের জাদুকর। এই জ্বিন আজান দিয়ে তাড়াতে হয়। এমনিতে যায় না।
মনে হচ্ছে তোমার উপন্যাস লেখার প্লট পেয়ে গেছ?
হ্যাঁ। গাইলানের অংশটা লিখেছ?
না।
লিখছ না কেন?
আমার আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।
উনি অবাক হয়ে বললেন, কেন ইচ্ছে করছে না?
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার বাছুর প্রেম চলে গেছে তো, এইজন্যে।
তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, বাছুর প্রেম শেষ?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বাছুর প্রেম শেষ, লেখালেখিও শেষ?
হুঁ।
কীভাবে শেষ হলো?
জানি না কীভাবে শেষ হলো। হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম…। থাক বলব না।
বলবে না কেন?
শুনলে আপনার হয়তো খারাপ লাগতে পারে।
আমার খারাপ লাগবে না, তুমি বলো।
হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম, আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে করে না, আপনার সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে না।
তুমি বলতে চাচ্ছ হঠাৎ লক্ষ করলে আমি একজন বিরক্তিকর মানুষ হয়ে গেছি?
জি।
আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং! তোমার বিয়ের কী হলো? ঐ যে দর্জি। আলাপ আলোচনা চলছে?
জানি না। আমি নিজ থেকে তো আর বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না, বাবা, আমার বিয়ের আলাপের কতদূর কী হলো।
আহসান সাহেব কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলেন। তিনি সিগারেট খুব কম খেতেন। ইদানীং কি সিগারেট খাওয়া বেড়েছে? সবসময় তাঁর হাতে সিগারেটের প্যাকেট।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট গলায় বললাম, চাচা যাই?
তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। ধোয়া ছেড়ে ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলবেন বলে ঠোঁট ফাঁক করলেন, কিছু বললেন না। আমি চলে এলাম। আমার চাচা ডাক নিশ্চয়ই তাঁর মরমে বিধেছে।
আমি তাঁর খেলাই তাঁকে ফেরত পাঠাচ্ছি।
What you looking for
What was her name
You can probably find her
At the grand chess game