আমি ভেবেছিলাম খবর হতে সময় লাগবে। রাত দশটা-এগারটা বেজে যাবে। তা হলো না। রাত আটটার দিকেই সকিনা ষাড়ের মতো চেঁচাতে লাগল। সকিনা বলছে, টাটকা মানুষ মাইরা তার পায়ের হাড্ডি আমার মশারির ভিতরে থুইছে। ও আল্লাগো! আমি কই যাব গো!
বড় মামা, বাবা এবং মা–এই তিনজনই মনে হলো অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই।
আমিই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বললাম, আমার ধারণা গাইলান বড় মামার ঘরে শুরুতে ভর করেছিল, এখন ভর করেছে সকিনার ঘরে। মনে হয় গাইলান দুজনের ওপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট।
বড় মামা খড়খড়ে গলায় বললেন, গাইলান কি তোমাকে এই খবর দিয়ে গেছে?
আমি বললাম, না। এই থিওরি নিজে নিজে চিন্তা করে বের করেছি।
বড় মামা বললেন, থিওরি কপচানোর বয়স এবং অভিজ্ঞতা তোমার এখনো হয় নি। কাজেই চুপ করে থাকবে।
জি আচ্ছা মামা।
বড় মামা বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, গাইলান ফাঁইলান কিছু না। আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যে ষড়যন্ত্র করছে তার জানা উচিত যে আমি ফিডার খাওয়া লোক না। সব বের করে ফেলব। তদন্তের ভার দেব ডিবি পুলিশকে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে ডিবির ইন্সপেক্টর। নাম খসরু। তাকে বললেই সে চব্বিশ ঘণ্টায় থলের বিড়াল বের করে তার গলায় ঘণ্টা বেঁধে দিবে।
মামা কঠিন মুখ করে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মনে হয় ডিবি ইন্সপেক্টর খসরু সাহেবের কাছে যাচ্ছেন। আমি বললাম, বড় মামা, আমরা কি হাড্ডিটা ফেলে দিব, না রেখে দিব ডিবি পুলিশের দেখার জন্যে?
বড় মামা জবাব দিলেন না।
রাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। আহসান সাহেব রাত দশটায় গিফট র্যাপে মোড়া একটা প্যাকেট পাঠালেন। সঙ্গে চিঠি। চিঠিতে লেখা–
Hello friend,
শুভ জন্মদিন। খুব দামি উপহার তোমাকে কখনো দিয়েছি বলে মনে করতে পারছি না। এবার দিলাম, কারণ তুমি ষোলতে পড়েছ। Sweet sixteen.
উপহারটা হচ্ছে, আমেরিকার অ্যাপল কোম্পানির wonder toy, ipad 2. এক হাজার গান আমি এই খেলনায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। চিরায়ত সাহিত্যের বেশ কিছু বইও আছে। নানান ধরনের খেলা আছে।
এই অপূর্ব খেলনার উদ্ভাবকের নাম স্টিভ জবস। বেচারা এই খেলনা আবিষ্কারের পরপরই ক্যানসারে মারা যান।
এখন বলো তুমি কেমন আছ? মেয়েদের সবচেয়ে রহস্যময় বয়স হচ্ছে ষোল, এটা কি জানো? এই বয়সেই মেয়েরা সচেতনভাবে তার সঙ্গী খুঁজতে শুরু করে।
Who you looking
for What was his name
You can probably find him
At the grand chess game
চিঠির এইখানেই সমাপ্তি।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল রাত এগারটায়। বড় মামা মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় বাড়িতে ঢুকে বমি করে সব ভাসিয়ে দিলেন। যে বিকট গন্ধ বের হলো এতে গাইলান জ্বিন দৌড়ে পালিয়ে যেত। আমার অতি ভালো মা অনেক রাত জেগে নিজে সেই বমি পরিষ্কার করলেন।
সকিনাকে পরিষ্কার করতে বলা হয়েছিল। সে বলেছে, পুলাপানের বমি আমি পরিষ্কার করি। বুড়া মাইনষের বমি পরিষ্কার করি না। লাখ টেকা দিলেও না।
.
গত সাত দিনে আহসান সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয় নি। তাঁকে টেলিফোনও করি নি। অষ্টম দিনে ছাদে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। আমি জানি উনি ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন। তারপরেও ভান করলাম–তাকে দেখতে পাই নি। ছাদে শুকাতে দেওয়া আচার আনতে গেছি। আমি যখন চলে আসছি তখন তিনি ডাকলেন, লিপি!
আমি ভয়ঙ্কর চমকে যাওয়ার ভাব করলাম। চমকানোর অভিনয় খুব ভালো হলো। কারণ চমকে আমি হাত থেকে আচারের বোতল ফেলে দিলাম। দুটা বোতলই ভেঙে চুরমার।
তিনি বললেন, সরি, তোমাকে চমকে দিয়েছি। পা কাটে নি তো?
আমি বললাম, মনে হয় কেটেছে। কিছু হবে না।
তিনি বললেন, কিছু হবে না মানে? দাঁড়াও, ডেটল নিয়ে আসছি।
উনি ডেটল আনতে ঢুকলেন, এই ফাঁকে আমি বাসায় চলে এলাম। কল্পনায় দেখছি, উনি ডেটল নিয়ে ফিরে এসে আমাকে না দেখে ধাক্কার মতো খেয়েছেন।
ব্যাকুল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।
তিনি অনেক খেলা আমার সঙ্গে খেলেছেন।
আমি এখন তার খেলা তাঁকে ফেরত দিচ্ছি। আমাকে নিয়ে তার প্রধান এক খেলার কথা বলি। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন, আমি স্কুলে যাচ্ছি। আমাকে দেখে বললেন, লিপি, স্কুল কখন ছুটি হবে?
আমি বললাম, চারটায়।
আমার সঙ্গে এক জায়গায় বেড়াতে যাবে?
আমার বুক ধক করে উঠল। আমি বললাম, অবশ্যই যাব।
তিনি বললেন, কোথায় যেতে চাও বলো।
আমি বললাম, আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানে যাব।
আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানে যাবে?
হুঁ।
সাভারের বাগানবাড়িতে যাবে? সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে দাবা খেলা। রাজি আছ?
হুঁ।
রাতে যদি থেকে যেতে বলি থাকবে?
হুঁ।
তারপর বাবা-মার কাছে কী জবাব দিবে?
আমি বললাম, কিছু-একটা বলব, সেটা আপনার না জানলেও চলবে।
তিনি বললেন, তাহলে স্কুল ছুটির পর অপেক্ষা কোরো। আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
আমি বললাম, আচ্ছা।
স্কুলে কীভাবে আমার দিন কাটল আমি বলতে পারব না। প্রবল এক ঘোর। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। অংক মিস বললেন, লিপি, তুমি এরকম করছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ করছে?
আমি বললাম, জি আপা।
তিনি বললেন, শরীর খারাপ নিয়ে ক্লাস করতে হবে না। বাসায় চলে যাও।