আমি বললাম, দাদিমা চুলে বেণি করেছ? দাদিমা বললেন, বেণি করলে তোর কী? তুই … দিয়া বেণি কর।
আমি ডট ডট দিয়ে যে শব্দটা লিখেছি সেই শব্দটার মানে খুব খারাপ। হিন্দিতে চুল বললে যা বোঝায় তা। দাদিমা সারাক্ষণ কোনো-না-কোনো খারাপ কথা বলতেন। একবার আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন…। না থাক, এটা বলা। যাবে না। আহসান সাহেব যদিও বলেছেন উপন্যাসে মিথ্যা থাকবে না। মিথ্যায় খারাপ কোনো প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। তারপরেও আমার মনে হয়, সব সত্যি লেখা উচিত না। উনাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে, নোংরা কথা থাকবে কি না। আমরা তো প্রায়ই নোংরা কথা বলি।
আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে, নাম প্রতিমা। প্রতিমার মতোই সুন্দর। কী সরল চেহারা! কী স্নিগ্ধ ছলছলা চোখ! দেখতে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খাওয়া দূরে থাকুক, সে ভাজা মাছই খেতে পারে না। অথচ এই মেয়ে কী যে অসভ্য! তার মুখে সারাক্ষণ নোংরা কথা। একদিন আমাকে বলে কী–লিপি! বিয়ে করার সময় খেয়াল রাখবি ছেলে যেন বেঁটে হয়।
আমি বললাম, কেন?
প্রতিমা গলা নামিয়ে বলল, বেঁটে ছেলেদের ওই জিনিস হয় লম্বা। তাদের সঙ্গে Sex করে খুব আরাম।
তুই করেছিস?
প্রতিমা গম্ভীর গলায় বলল, না করলেও জানি।
আমার উপন্যাসে আমি অল্প কয়েকটা চরিত্র নিয়ে আসব। যেমন, আমার পরিবারের লোকজন। বাইরের মানুষ হিসেবে থাকবেন শুধু আহসান সাহেব এবং আমার বান্ধবী প্রতিমা। আহসান সাহেব আমার বাবার বন্ধু। বাবা আরমানিটোলা স্কুলে তাঁর সঙ্গে পড়তেন। স্কুলে কিছু কিছু ছেলেদের বিশেষ বিশেষ নামে ডাকা হয়। আহসান সাহেবকে ডাকা হতো মার্বেল নামে। কারণ তিনি স্কুলে যেতেন পকেটভর্তি মার্বেল নিয়ে।
আপনারা নিশ্চয়ই একটু অবাক হচ্ছেন, কারণ আমি বাবার বন্ধুকে চাচা না বলে আহসান সাহেব, আহসান সাহেব বলছি। এর কারণ হচ্ছে, আমি ওনাকে বিয়ে করব। চমকে গেলেন না? আমার উপন্যাসের এইটাই সবচেয়ে বড় চমক। এই চমকটা শেষের দিকে আসবে। আমি যে তাঁকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি এই বিষয়টা আহসান সাহেব নিজেও জানেন না। যেদিন জানবেন সেদিন তিনিও চমক খাবেন। যাই হোক, আহসান সাহেব সম্পর্কে বলি।
চৌধুরী আহসান উদ্দিন।
বয়স : ৫৫
রাশি : বৃশ্চিক।
উচ্চতা : পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি
ওজন : জানি না।
গাত্রবর্ণ : শ্যামলা
পেশা : ইঞ্জিনিয়ার।
(একসময় ছিলেন, এখন ঘরে বসে সময় কাটান। বই পড়েন।)।
বিশেষ চিহ্ন : বাঁ চোখের ভুরুর ওপর কাটা দাগ।
চুলের বর্ণ : কালো।
চোখের বর্ণ : কালো
বৈবাহিক অবস্থা : (সমস্যা আছে)….
ধর্ম : ইসলাম।
বৈবাহিক অবস্থার জায়গায় আমি লিখেছি, সমস্যা আছে। আসলে কোনো সমস্যা নেই। ভদ্রলোকের স্ত্রী রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। ভদ্রলোক নিজেই। গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হুড়মুড় করে গাড়ির ওপর একটা ট্রাক উঠে গেল। তার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন। অনেকদিন হাসপাতালে ছিলেন। এখনো সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। স্ত্রী মারা যাওয়ায় তিনি যে খুব দুঃখিত হয়েছেন তা আমি মনে করি না। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কখনো। গল্প করেন না। স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ পড়ান না বা ফকির খাওয়ান না। বেচারির একটা ছবি অবশ্যি তাদের শোবার ঘরে আছে। সেখানে এই মহিলা স্বামীর হাত ধরে সমুদ্র দেখছেন। ভদ্রমহিলার মুখ খুশি খুশি, কিন্তু তার স্বামী অর্থাৎ আহসান সাহেব মুখ বেজার করে আছেন। ছবিতে তাকে দেখে মনে হয় তাঁর প্রচণ্ড বাথরুম পেয়েছে। এই মুহূর্তে বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। নয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
আহসান সাহেবের বৈবাহিক বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই, তারপরেও আমি কেন লিখলাম, সমস্যা আছে? এর একটা কারণ আছে। একদিন আমি ছাদে গিয়েছি আচারের বৈয়াম আনার জন্যে। আমার মার আচার বানানোর ব্যাপার। আছে। তিনি হেন বস্তু নেই যার আচার বানান না। আমাদের বাসার ছাদে সব সময় ত্রিশ থেকে চল্লিশটা, আচারের বৈয়াম থাকে। এর মধ্যে তিতা করলার আচারও আছে। মার আচারের বিষয়ে পরে গুছিয়ে বলব। এখন আহসান সাহেবের বৈবাহিক সমস্যাটা বলে শেষ করি।
উনার স্ত্রী মারা যাওয়ার আগের কথা।
আমি ছাদে গিয়ে দেখি আহসান সাহেব মোবাইল টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। বেশ জোরে জোরেই কথা বলছেন। আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।.উনি আস্তে বললেও শুনতে পেতাম। আমার কান খুব পরিষ্কার। কেউ। ফিসফিস করে কথা বললেও আমি শুনতে পাই। আহসান সাহেবের টেলিফোনের কথাবার্তা এ রকম—
আহসান সাহেব : আপনাকে তো একবার বলেছি। একই কথা রিপিট করে কী হবে?
ওপাশ থেকে : (শোনা যাচ্ছে না। তবে অনেকক্ষণ ধরে কথা)।
আহসান সাহেব : আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ না করে কিছু বলব না।
ওপাশ : (অল্প সময় কথা)
আহসান সাহেব : আমাকে অবশ্যই রেনুকার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ওপাশে : (কান্নার মতো শব্দ)
আহসান সাহেব : স্টপ ক্রায়িং প্লিজ। তোমাকে মনে রাখতে হবে, রেনুকাকে আমি ভালোবাসি বা না বাসি, তার সঙ্গে দীর্ঘদিন বাস করছি।
ওপাশ : (কী বলল বোঝা গেল না। আহসান সাহেবের বিরক্ত মুখ থেকে ধারণা করি–কথাগুলো তার পছন্দ হচ্ছে না।
আহসান সাহেব : তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। পেশেন্স।