সাত দিন আগের কথা। অনেক ঘ্যানঘ্যানানির পর বাবা আমাকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন। চার হাজার তিন শ টাকা দাম। মোবাইল ফোন নিয়ে প্রথমেই আহসান সাহেবের কাছে গেলাম। আনন্দে খলবল করতে করতে বললাম, এই যে আমার মোবাইল ফোন।
উনি বললেন, বাহ্ সুন্দর তো! মোবাইলে কম্যুনিকেশন কীভাবে হয় জানেন?
আমি বললাম, না।
কমুনিকেশন হয় মাইক্রোওয়েভে। এখন বলল, মাইক্রোওয়েভ কী?
আমি জানি না মাইক্রোওয়েভ কী।
জানতে চাও?
না, চাই না। আমি আর্টস-এর ছাত্রী, শুধু শুধু সায়েন্সে যাব না। কম জানা যেমন খারাপ, বেশি জানাও খারাপ।
তিনি বিরক্তির মতো ভঙ্গি করলেন।
আমি বললাম, আপনার মোবাইল নম্বরটা দিন।
উনি অবাক হওয়ার মতো করে বললেন, কেন?
আপনাকে টেলিফোন করব।
আমাকে কেন টেলিফোন করবে? তুমি টেলিফোন করবে তোমার বন্ধু বান্ধবকে। আর তোমার সঙ্গে তো আমার দেখা হচ্ছেই। যদি অনেক দূরে কোথাও যাও তখন নম্বর নিয়ো। আমার নম্বর কাউকে দেই না। প্রয়োজন হলে আমি টেলিফোন করি।
আপনি টেলিফোন করলেই তো নম্বর উঠে যাবে।
আমারটা উঠবে না। আমার ক্ষেত্রে উঠবে Private Number, বুঝেছ?
জি।
আচ্ছা এখন যাও।
আমি চোখভর্তি পানি নিয়ে চলে এলাম। তখনই ঠিক করলাম পাশা খেলব। আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম। যে আমার সঙ্গে দাবা খেলায় পারে না সে পাশা খেলাতেও পারবে না।
.
বড় মামার ঘরে দ্বিতীয় দফায় ভৌতিক আক্রমণ হলো চার দিন পরে। এবার মোস্তফা ভাই রক্ত এনে দেন নি। আমি ব্যবস্থা করেছি। এক বোতল রুহ আফজা ঢেলে নিয়েছি। এই সিরাপ খুব ঘন। রক্তের মতো লাল। নাটকে-সিনেমায় রুহ্ আফজা রক্ত হিসেবে ব্যবহার করে।
এবার প্রথমবারের মতো হইচই হলো না। সবাই ঝিম মেরে গেল। শুধু আমার ছোট ভাই রুবেল তার গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করতে করতে চেঁচাল–অক্ত, অক্ত, অক্ত। সে রক্ত বলতে পারে না। নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, উবেল।
মামার ঘর বন্ধন দেওয়া হয়েছে। ঘরের চারকোনায় চারটা তাবিজ ঝুলছে। মা তার মহিলা পীরের কাছ থেকে মাটির সরায় কী সব লিখে এনেছেন। এই মাটির সরা রাখা হয়েছে বড় মামার বাথরুমে। মহিলা পীর বলেছেন, রক্ত-বিষয়ক কর্মকাণ্ড জ্বিনদের কারণে ঘটছে। কাজেই মাটির সরায় বাথরুম শুদ্ধি। জ্বিনরা নাকি বাথরুমে থাকতে পছন্দ করে।
জ্বিনের বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন হুজুরকেও আনা হয়েছে। হুজুরের মুখভর্তি সাঈদীর মতো লাল দাড়ি। তাঁর গা থেকে সস্তা আতরের বিশ্রী গন্ধ আসছে। তিনি আবার জর্দা দিয়ে পান খান। আতরের গন্ধের সঙ্গে জর্দার গন্ধ মিলেমিশে ভয়ঙ্কর এক গন্ধ তৈরি হয়েছে। এই গন্ধেই জ্বিন-ভূতের পালিয়ে দেশান্তরি হওয়ার কথা।
হুজুর বড় মামার ঘরে পা দিয়েই বললেন, সর্বনাশ!
বড় মামা বললেন, সর্বনাশ কেন?
যে জিনিস এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে তার নাম গাইলান। গাইলান হলো জ্বিনদের জাদুকর। একে দূর করতে হলে আজান দিতে হবে।
বড় মামা বললেন, আজান দিতে হলে আজান দিন। আজান দিতে তো নিষেধ নাই।
হুজুর বললেন, এখন আজান দিয়ে লাভ নাই। গাইলান উপস্থিত নাই। আজান দিতে হবে তার উপস্থিতিতে।
বড় মামা বললেন, গাইলান গেছে কোথায়?
হুজুর বললেন, সেটা তো জনাব আপনাকে বলতে পারব না। গাইলান আমাকে তার ঠিকানা দিয়ে যায় নাই। তার মোবাইল নম্বরও আমার কাছে নাই।
বাবা বললেন, আমাদের করণীয় কী সেটা বলেন।
গাইলান দেখলেই আজান দিবেন। অজু করে পবিত্র হয়ে আজান দিবেন।
আমি বললাম, হুজুর, আজানের ক্যাসেট নিয়ে এসে সারা দিন এই ঘরে বাজালে কেমন হয়?
হুজুর কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েছেলের এইসব আলাপে থাকা ঠিক না। গাইলানের প্রধান দৃষ্টি থাকে মেয়েছেলের দিকে।
আমি হুজুরের সামনে থেকে চলে এলাম। রক্তের বদলে রুহ আফজা দেওয়ায় ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেল। বড় মামার ঘর ভর্তি হয়ে গেল পিঁপড়ায়। সাধারণত কালো পিঁপড়া যেখানে থাকে, সেখানে লাল পিঁপড়া থাকে না। বড় মামার ঘর ভর্তি হয়ে গেল সবধরনের পিঁপড়ায়।
বড় মামা হতাশ গলায় বললেন, এই ঘরের কী সমস্যা কিছুই তো বুঝতে পারছি না। গাইলান-ফাইলান সব ফালতু বাত।
বাবা বললেন, ঘটনা ঘটছে কীভাবে?
বড় মামা বললেন, তা জানি না। আমি পুলিশে খবর দিব। পুলিশ এসে গাইলানকে কানে ধরে নিয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতে বড় মামা আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমাকে সন্দেহ করছেন না তো?
লিপি!
জি বড় মামা।
ঠিক করে বলো তো, পুরো ঘটনায় তোমার ভূমিকা কী?
আমি বললাম, মামা! আমার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বড় মামা বললেন, বলো শুনি। এটা কি কোনো প্রাকটিক্যাল জোক?
আমি বললাম, গাইলানের তরফ থেকে প্রাকটিক্যাল জোক হতে পারে। আমার তরফ থেকে না। আমি একজন দর্শক। সায়েন্সের ভাষায়–Ovserver.
বড় মামা বললেন, একটু আগে বলেছ তোমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখন কেন পিছিয়ে আসছ?
আমি বললাম, মামা, পিছিয়ে আসছি। Ovserver-এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে Ovserver ছাড়া কোনো ঘটনাই ঘটবে না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আহসান চাচুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মামা কিছু না বলে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম। সন্ধ্যাবেলা মোস্তফা ভাই উপস্থিত। তাকে একটা গরুর পায়ের রক্তমাখা হাড় আনতে বলেছিলাম। তিনি বড় পলিথিনের ব্যাগে করে হাড় নিয়ে এসেছেন। জায়গায় জায়গায় মাংস ও রক্ত লেগে আছে। আমি এক ফাঁকে সকিনার ঘরে মশারির ভেতর রেখে দিলাম। সকিনা তার ঘরে সারাক্ষণ মশারি টাঙিয়ে রাখে। ফুরসুত পেলেই মশারির ভেতর ঢুকে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আসে। এবার যখন ঘুমুতে যাবে তখন খবর হয়ে যাবে।