বাবার গল্প পুরোটা শোনা গেল না। প্রতিমা এসেছে। সে দরজার ওপাশ থেকে চোখে ইশারা করছে।
আমি বাবাকে বললাম, তোমার তাহেরপুর অপারেশনের গল্প শোনার জন্যে প্রতিমাও চলে এসেছে। বাবা আমাকে দশ মিনিট সময় দাও। প্রতিমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলব, তারপর দুজনে মিলে তোমার গল্প শুনব।
বাবা বললেন, অবশ্যই। মনে করিয়ে দিস, গৌরাঙ্গের কথা বলব। সব সময় তার কথা মনে থাকে না। অসাধারণ চরিত্র। বীর উত্তম পদক পাওয়া উচিত ছিল। কিছুই পায় নি। এখন শুনেছি সুনামগঞ্জ শহরে রিকশা চালায়। আফসোস আফসোস।
প্রতিমা আমার কাছে বিশেষ কাজে এসেছে। সে আমার উপন্যাসের শুরুটা লিখে এনেছে। তার শুরু এ রকম–
আমাদের বাড়ির রেলিংয়ে একটা দাঁড়কাক এসে বসেছে।
দাঁড়কাকটা সাইজে যথেষ্টই বড়। তার চোখ টকটকে লাল।
সে লাল চোখে আমাকে দেখছে।
আমার খানিকটা লজ্জা লজ্জা লাগছে। কারণ আমার
গায়ে কোনো কাপড় নেই। আমি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আমার ঘরে
অপেক্ষা করছি। কার অপেক্ষা? শুভ্রর জন্যে অপেক্ষা। শুভ্র
এখন মার সঙ্গে রাজনীতির গল্প করতে করতে চা খাচ্ছে।
তার বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। ফিরে যাওয়ার
আগে সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসে দেখবে
নেংটো কন্যা বসে আছে।
প্রতিমা বলল, এই পর্যন্ত লিখেছি। ঠিক আছে?
আমি বললাম, ঠিক আছে। তবে শুভ্র নাম দেওয়া যাবে না। শুভ্র হুমায়ূন আহমেদের ক্যারেক্টার। অন্যের চরিত্র নিয়ে কাজ করব না। এখন চল মুক্তিযুদ্ধ সেশান। বাবা গল্প বলার জন্যে জিহ্বা শাণ দিয়ে বসে আছেন।
রক্ত-চিকিৎসার প্রস্তুতি সম্পন্ন
রক্ত-চিকিৎসার প্রস্তুতি সম্পন্ন।
বড় মামার ঘরে কোকের বোতলের এক বোতল রক্ত ঢেলে এসেছি। বোতলে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। গরম পানি দিয়ে ঝাঁকিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তিন জায়গায় রক্ত ঢালা হয়েছে–মামার টেবিলে, মেঝেতে, বাথরুমের বেসিনে। বাথরুমের বেসিনের রক্ত সবচেয়ে ভালো ফুটেছে। ধবধবে সাদা বেসিনে টকটকে লাল রক্ত। বিছানায় খানিকটা ঢালার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিছানার চাঁদরটা মেরুন রঙের, রক্ত ফুটবে না।
বাসায় সবাই আছে, শুধু বড় মামা নেই। উনি ঘরে ঢুকলেই খেলা শুরু হবে। আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম। বড় মামার অবস্থা কী হয় তা দেখার জন্যে ছটফট করছি।
মা রান্নাঘরে, মোরগপোলাও রান্না করছেন। সকিনা তাকে সাহায্য করছে। বাবা টিভি ছেড়েছেন, ফুটবল খেলা দেখছেন। ফুটবল খেলার দর্শক হিসাবে বাবা আদর্শ। তিনি কোনো দলকেই সাপোর্ট করেন না। সবাইকে গালাগালি করেন। বাবার গালাগালি আমার কাছে ফুটবল খেলার চেয়েও ইন্টারেস্টিং লাগে।
এই মুহূর্তে বাবা চেঁচাচ্ছেন, সবাই মিলে এটার পাছা বরাবর লাথি দেয় না কেন? বদের বাচ্চা। খেলা জানস না খেলতে আসছস কী জন্য? বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ খা বদমাইশ!
গালাগালির এই পর্যায়ে বড় মামা বাড়িতে ঢুকলেন। তালা খুলে নিজের ঘরে দাখিল হলেন। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বড় মামা কি রক্তের বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন? নাকি এখনো তাঁর চোখে পড়ে নি। টেনশনে আমার শরীর কাঁপা শুরু হয়েছে। একবার কি উঁকি দিয়ে দেখব?
হঠাৎ করেই মামার বিকট চিৎকার শুরু হলো।
ফরিদা কোথায়? ফরিদা! এই, কে আছে বাসায়? এই এই এই?
আমরা সবাই হুড়মুড় করে বড় মামার রুমে ঢুকলাম। বড় মামা বাবার দিকে। তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, এইসব কী? ভাবটা এ রকম যেন, ঘটনা বাবা ঘটিয়েছেন।
বাবা বললেন, রক্ত নাকি? রক্ত কোত্থেকে এল?
রক্তের কথা শুনে সকিনা ও আল্লাগো, মাইনষের রক্ত! বলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করল।
বাবা বললেন, ন্যাকামি করিস না। রক্ত কোনোদিন দেখস নাই? ফুটবল প্লেয়ারের মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিস! তোকে কেউ ল্যাং মেরেছে?
বড় মামা বাবার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, রক্ত কোথা থেকে এসেছে সেটা নিয়ে কথা বলো। খামাকা চেঁচাচ্ছ কেন?
বড় মামার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ভাইজান, বাথরুম ভর্তি রক্ত। মাবুদে খোদা! এইসব কী?
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। বাবা তার বন্ধু ও বস আহসান সাহেবকে ডেকে এনেছেন। তিনি গম্ভীর মুখে রক্ত দেখে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টিতে চাপা হাসি এবং কিছুটা আনন্দ।
আহসান সাহেব আমাকে বললেন, লিপি, আমি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করছি। তুমি এক কাপ চা নিয়ে ওপরে আসো।
আমি বললাম, জি আচ্ছা চাচা।
আহসান সাহেব থতমত খেলেন। এই প্রথম আমি তাঁকে চাচা ডাকলাম।
আমি চা নিয়ে নিজে গেলাম না। সকিনাকে দিয়ে পাঠালাম। আমি নিজের কোর্টে বল নিয়ে আসতে শুরু করেছি। আমি জানি আহসান সাহেবের আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা করছে। আমাকে না দেখে সেই ইচ্ছাটা আরও বাড়বে। আমি এর ভেতর দিয়ে গিয়েছি। আমি জানি।
সকিনা ফিরে এসে বলল, বড় স্যার আপনেরে টেলিফোন করতে বলেছে।
আমি টেলিফোন করলাম না। উনার এখন অপেক্ষার পালা। আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে।
আমার প্রেম যদি বাছুর প্রেম হয়, তারটা তাহলে কী? বৃদ্ধ গরু প্রেম? বৃদ্ধ গরু প্রেমও কি বাছুর প্রেমের মতো কঠিন? দেখা যাক। আমি টেলিফোন না করলে উনি আমাকে করতে পারবেন না। কারণ আমার নম্বর তিনি জানেন না। কোনোদিন জানার আগ্রহ দেখান নি।