আমি মিষ্টি করে হাসলাম। উনি আবারও থতমত খেলেন। বুঝতেই পারছি তিনি কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। যাক, শেষ পর্যন্ত কথা খুঁজে পেলেন।
আধাপৃষ্ঠা কী লিখেছিলে যে ফেলে দিতে হলো?
ভৌতিক কিছু করতে চেয়েছিলাম। তালাবন্ধ ঘর খুলে দেখা গেল ঘরের মেঝেতে, বিছানায়, বাথরুমে রক্ত।
তিনি বললেন, ইন্টারেস্টিং!
লেখাটা ইন্টারেস্টিং হয় নি। ফালতু হয়েছে।
আবার লেখো। রবার্ট ব্রুস হয়ে যাও।
আমি বললাম, আচ্ছা।
তিনি বললেন, শাড়িতে তোমাকে মানিয়েছে। মাঝে মাঝে শাড়ি পরবে। শাড়ির যে ক্ষমতা আছে পৃথিবীর অন্য কোনো পোশাকের এই ক্ষমতা নেই।
কী ক্ষমতা?
শাড়ি একটা মেয়ের পার্সোনালিটি বদলে দিতে পারে।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, যাই।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, যাই মানে! তোমাকে দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করার জন্যে ডেকেছি।
আমি বললাম, মা খুব দুশ্চিন্তা করছেন তো, এইজন্যে চলে যেতে হবে। দুশ্চিন্তা করছেন কেন?
আমি বললাম, মা মোটামুটি নিশ্চিত, আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। এইজন্যেই দুশ্চিন্তা করছেন। পাত্র খুঁজছেন আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্যে। মার ধারণা বিয়ে হলে আমার পাগলামি সেরে যাবে। পাত্র খোঁজা হচ্ছে, একজন পাওয়া গেছে।
তিনি বললেন, লিপি, পাঁচ মিনিট বসো। আমার কথা শুনে চলে যেয়ো। আমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে না। তোমার খাবার পাঠিয়ে দেব।
আমি বসলাম। তিনি বললেন, তোমার মা বলছেন বিয়ের পর তোমার পাগলামি সেরে যাবে। কথা কিন্তু ঠিক। তবে বিয়ে না করলেও পাগলামি সারবে। তোমার যা হয়েছে তার নাম Calf love, বাংলায় বাছুর প্রেম। Calf love-এ তীব্র আবেগ থাকে, তবে তা হয় ক্ষণস্থায়ী।
আমি বললাম, ও আচ্ছা।
তিনি বললেন, বাছুর প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তোমার কল্পনাশক্তি। নানান কিছু তুমি কল্পনা করছ। এডোলেসেন্ট পিরিয়ডে কল্পনা মানুষকে রিয়েলিটির বাইরে নিয়ে যায়। বুঝেছ?
হুঁ।
তোমার জন্যে যে পাত্র পাওয়া গেছে, সে কী করে?
সে দর্জি।
আহসান সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, কী বললে? দর্জি?
আমি বললাম, মেয়েদের ব্লাউজ বানানো টাইপ দর্জি না। স্যুট কোট এইসব কাটে। মাস্টার টেইলর। ময়মনসিংহে তাদের বিশাল দোকান। ছেলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাঁচ নম্বর সেক্টরে বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।
বাড়ি কোথায় বললে? ময়মনসিংহ?
জি। লেখক হুমায়ূন স্যারের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। হুমায়ুন স্যার বলেছেন, ছেলে খুবই ভালো।
তার সঙ্গে কি এখন তোমার খাতির হয়ে গেছে?
তা না। আমার লেখা নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছি। তখন থেকে পরিচয়। আমার উপন্যাসের একটা নাম তিনি দিয়েছেন। তিনি নাম রেখেছেন দাঁড়কাকের সংসার। নামটা ভালো হয়েছে না?
তোমার লেখা উনি পড়েছেন?
হুঁ। যা-ই লিখি তাঁকে পড়াই। শাওন আপুকেও পড়াই।
শাওন আপুটা আবার কে?
উনার স্ত্রী। ভৌতিক যে অংশটা লিখে ফেলে দিয়েছি, সেটা শাওন আপু খুবই পছন্দ করেছিলেন। হুমায়ূন স্যার যেই বললেন, ভালো হয় নি, সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিয়েছি। শাওন আপু তো আর লেখক না। তাঁর কথায় গুরুত্ব দেব কেন?
আহসান সাহেব কিছুই বললেন না, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তবে আমার কথায় বড় রকমের ধাক্কা যে তিনি খেয়েছেন তা বুঝলাম যখন দুপুরে আমার জন্যে কোনো খাবার এল না। খাবার পাঠানোর মতো মনের অবস্থা হয়তোবা তার ছিল না। কিংবা এও হতে পারে যে, তিনি ভুলে গেছেন।
সন্ধ্যাবেলা বড় মামা আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ফরিদার কাছে শুনলাম তুমি নাকি আজ সেজেগুজে চোখে কাজল দিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছ?
ঠিকই শুনেছেন। ফটোসেশন ছিল তো, এইজন্যেই সেজেগুজে যাওয়া।
ফটোসেশন মানে?
আমার ছবি তোলা হলো। ফটোগ্রাফার হলেন মবিন সাহেব। গ্ল্যামার ফটোগ্রাফিতে তাঁর মতো কেউ বাংলাদেশে নাই।
ফটোসেশন হলো কেন?
কারণ আছে। এখন বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না? তোমার এবং বাড়িওয়ালা বুড়োটার মধ্যে সম্পর্কটা কী আমাকে বলো। ঝেড়ে কাশো।
আমি বললাম, কাশি থাকলে তবেই না ঝেড়ে কাশার প্রশ্ন আসে। আমার কোনো কাশি নেই।
বড় মামা বললেন, তুমি অবাধ্য, দুর্বিনীত বখাটে একটি মেয়ে। A spoiled Girl, বুঝেছ?
আমি বললাম, এখনো বুঝতে পারি নি। আপনি বুঝিয়ে দিন।
মা পুরো বিষয় ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে বললেন, ভাইজান, বাদ দিন। লিপির বয়স কম। সে কী বলে না বলে নিজেও জানে না।
বড় মামা বললেন, তোমরা জানতে দাও না বলে জানে না। এই মেয়ে আমার ঘরে জন্ম নিলে সরলরেখা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম।
রাতে বড় মামা দুই দফা মিটিং করলেন। মার সঙ্গে মিটিং, বাবার সঙ্গে মিটিং।
রাত সাড়ে এগারটার দিকে বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। তাঁর চিন্তিত শুকনা মুখ দেখে আমার খুব মায়া লাগল। তাঁকে খুশি করার জন্যে বললাম, বাবা! তোমাদের তাহেরপুর অপারেশনের গল্পটা আরেকবার বলো তো।
কেন?
আমাকে একটা রচনা লিখতে হবে–মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন।
বাবার মুখের চিন্তিতভাব মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। তিনি তাহেরপুর অপারেশনের গল্প শুরু করলেন।
তারপর ঘটনা শোনো। চব্বিশ ঘণ্টা পর প্রথম পেটভর্তি খিচুড়ি খেলাম। খিচুড়ি আর মোরগের সালুন। খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, এমন সময় আমাদের কমান্ডার সালেহ চৌধুরী বললেন, অস্ত্র হাতে নাও। আমরা তাহেরপুর যাব।…