রক্তের জন্যে অপেক্ষা। রক্ত এলেই বড় মামার চিকিৎসা শুরু হবে। জল চিকিৎসার মতো রক্ত-চিকিৎসা।
.
বড় মামার বিষয়ে বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আরে না ছোট প্যাকেট বিষয়ে না। বাবার সঙ্গে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় নাকি? মার সঙ্গে কথা বলা যায়। তবে এখনো না। সময় হোক তখন বলব।
বাবা আমার ঘরে ঢুকে দরজা ভিজিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার বড় মামা বিষয়ে কিছু কথা বলব।
আমি বললাম, বলো। তবে আজেবাজে কিছু বলবে না। উনি সুফিটাইপ মানুষ।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, সে সুফি?
আমি বললাম, মার তা-ই ধারণা। বড় মামা উল্টাপাল্টা কাজ যা করেন, মামির ঠেলাঠেলিতে করেন। এখন মামি যেহেতু সঙ্গে নেই, বড় মামা পুরোপুরি সুফি।
তোমার মার এই ধারণা?
হুঁ।
তাহলে তো আর বলার কিছু নাই।
আমি বললাম, তারপরেও কিছু বলার থাকলে বলো।
বাবা বললেন, ডেভেলপারকে দিয়ে তোমার মামা যে দশতলা দালান তুলছে। এটা নিয়ে খটকা।
বলো, শুনি কী খটকা?
ডেভেলপারেরা তো জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করবে। তোমার মা-ও তো জমির মালিক। তার সঙ্গে তো কোনো চুক্তি হয় নাই।
তাহলে মা মনে হয় জমির মালিক না। বড় মামাই মালিক।
সেটা কীভাবে সম্ভব?
এই দুনিয়ায় সবই সম্ভব।
তুমি কি বিষয়টা নিয়ে তোমার বড় মামার সঙ্গে আলাপ করবে?
আমি আলাপ করব কোন দুঃখে! তোমার খটকা তুমিই আলাপ করো।
আমাকে লোভী ভাববে।
তোমাকে লোভী ভাবলে ক্ষতি তো কিছু নাই। তুমি তো লোভী। লোভীকে লোভী ভাবা দোষের কিছু না। তারপরেও লজ্জা লাগলে মাকে বলো জিজ্ঞেস করতে।
তোমার মাকে বলেছিলাম, সে কান্নাকাটি করে বিশ্রী অবস্থা করেছে। আমাকে ছোটলোক বলেছে। এখন কী করা যায় বলো তো?
ঝিম ধরে থাকো। আর কী করবে?
বাবা কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে বের হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে আজ সারা দিন তিনি ঝিম ধরেই থাকবেন।
নিম ফুলের মৌ পিয়ে ঝিম ধরেছে ভোমরা
ঝিম ধরেছে ভোমরা
ঝিম ধরেছে ভোমরা।
বাবা এখন ভোমরা!
.
আজ সোমবার।
আমার খারাপ দিবস। আজও নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটবে। ঘটুক। আমিও বাবার মতো ভোমরা হয়ে যাব। অনেকদিন পর উপন্যাস লিখতে বসলাম।
আমার বড় মামার ঘরে ভূতের উপদ্রব হয়েছে। তিনি বাইরে থেকে ফিরে ঘরের তালা খুলে দেখেন–ঘর রক্তে ভেজা। মেঝেতে রক্ত, বিছানায় রক্ত, এমনকি বাথরুমেও রক্ত। বড় মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, কী ব্যাপার? এইসব কী?
আমি বললাম, মনে হচ্ছে রক্ত।
বড় মামা বললেন, ঘরে রক্ত আসবে কেন?
আমি বললাম, তুমি যখন থাকো না তখন মনে হয়। কোনো ড্রাকুলা এসেছিল…।
এই পর্যন্ত লিখে আমি কেটে ফেললাম। লেখা পছন্দ হয় নি। সত্যি সত্যি রক্ত ঢেলে দেখতে হবে বড় মামা কী বলেন। তারপর লিখতে হবে। নয়তো লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা পাবে না।
দুপুরে আহসান সাহেবের গাড়ির নতুন ড্রাইভার এসে আমাকে বলল, স্যার আপনারে আইজ দুপুরে তাঁর সঙ্গে খানা খেতে বলেছেন!
আমি বললাম, উনাকে গিয়ে বলল সোমবার আমি ঘর থেকে বের হই না। আচ্ছা থাক কিছু বলতে হবে না।
মা রান্না করছিলেন, আমি মাকে বললাম, মা তোমার একটা সুন্দর শাড়ি দাও তো। হালকা সবুজ রঙের শাড়ি থাকলে ভালো হয়।
কী করবি?
আমি বললাম, শাড়ি দিয়ে মানুষ কী করে মা? হয় সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে সুইসাইড করে, আর না হলে পরে। আমি পরব।
শাড়ি এখন পরবি?
হ্যা এখন। বাবার বন্ধু এবং বস আহসান সাহেব আমাকে আজ দুপুরে খেতে বলেছেন। সেজেগুজে যেতে হবে।
সেজেগুজে যেতে হবে কেন?
উনি বলেছেন এইজন্যে। বিশেষভাবে বলেছেন আমি যেন শাড়ি পরে যাই। শাড়ি পরলে আমাকে কেমন দেখায় তা তিনি দেখতে চান।
আমার কথা শুনে মার হাতের খুন্তি মেঝেতে পড়ে গেল। আমি বললাম, মা, তোমার কাজলদানিতে কি কাজল আছে? উনি বলেছেন আমি যেন অবশ্যই চোখে কাজল দেই। মেয়েদের চোখে কাজল তার নাকি খুব পছন্দ।
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, লিপি! মা, এইসব কী বলছিস?
আমি হাই তোলার মতো ভঙ্গি করে বললাম, যা সত্যি তা-ই তোমাকে বলেছি। তবে তুমি যদি বলো না যেতে তাহলে যাব না।
মা বললেন, যাওয়ার দরকার নেই। বলে দে তোর জ্বর, শুয়ে আছিস।
তারপর যদি ডাক্তার নিয়ে চলে আসেন তখন কী হবে? উনি আমাদের ওপর রাগ করলেও তো বিরাট সমস্যা।
কী সমস্যা?
বাবার চাকরি চলে যাবে। আমাদের এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
মা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে মায়া লাগছে।
আজ সোমবার, কিন্তু আজকের সোমবার অন্য দিনের মতো না। আমার জীবনে ভালো ভালো জিনিস ঘটছে। মোস্তফা ভাই কোকের বোতলে করে প্রায় এক বোতল রক্ত নিয়ে এসেছেন। এখন রক্ত-চিকিৎসা শুরু করতে পারব।
আহসান সাহেব এই প্রথম আমাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলেন। তিনি যে খানিকটা থতমত খেয়ে গেছেন তা বুঝতে পারছি। মেয়েরা কিছু কিছু জিনিস বুঝতে পারে। থতমত খাওয়া পুরুষ চোখ নামিয়ে নেয়। তখন তার দৃষ্টি হয়। এলোমেলো। থতমত ভাব কাটানোর চেষ্টার কারণে চেহারায় বিরক্তি চলে আসে। এই বিরক্তি নিজের ওপর।
আহসান সাহেব বললেন, উপন্যাস লেখা কি বন্ধ?
বন্ধ কেন? আধাপৃষ্ঠা লিখেছিলাম। পছন্দ হয় নি বলে ফেলে দিয়েছি।
ভালো করেছ। ফেলে দেওয়া অভ্যাস করতে হবে। লেখকের সবচেয়ে বড় বন্ধু হলো ডাস্টবিন। অপছন্দের লেখা ডাস্টবিনে ফেলতে পারা ভালো গুণ। কেউ কেউ আছে কিছুই ফেলতে পারে না।