আমি বললাম, আচ্ছা।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই মহিলা আমাকে শুধু ডিমভাজা আর ডাল দিয়ে খাবার কেন দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে মোস্তফাঁকে ধমক দিলেন। ফ্রিজ থেকে মাং বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে দিতে বললেন।
এক পর্যায়ে লেখক আমার পাশের চেয়ারে খেতে বসলেন। তাকে দেওয়া হলো পাতলা খিচুড়ি। তিনি এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। এত রাতে না খাইয়ে তাঁকে কেন ছেড়ে দিল ভেবে আমার লেখকপুত্রের মতো লাগ হয়ে গেল।
আমি ভেবেছিলাম লেখক সাহেব আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না। পাতলা খিচুড়ি খেয়ে চলে যাবেন। তিনি তা করলেন না। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, তুমি বলছিলে তোমার নাম মৃন্ময়ী। এটা তোমার আসল নাম না। আসল নাম কী?
আমি বললাম, আসল নাম না তা কীভাবে বুঝলেন?
মৃন্ময়ী শব্দটা যেভাবে উচ্চারণ করেছ সেখান থেকে বুঝেছি।
আমার নাম লিপি।
এইবার তিনি সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ লিপি?
আমি বললাম, ভালো আছি।
কতটা ভালো?
অনেকখানি ভালো।
একটা উপদেশ কি তোমাকে দিতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা কতটা দুশ্চিন্তা করছেন বুঝতে পারছ?
পারছি।
না, পারছ না। এখন যদি তুমি বাসায় উপস্থিত হও, তোমাকে দেখে তোমার বাবা আনন্দে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠো, শাওন তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবে।
জি আচ্ছা।
রাত একটায় শাওন ম্যাডাম মোস্তফাঁকে নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিলেন। বাবার সঙ্গে তার কোনো কথা হলো না, কারণ বাবা আমাকে দেখেই মাগো কোথায় ছিলি বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আহসান সাহেব আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তাঁর মুখ ভয়ংকর গম্ভীর।
আহসান সাহেব বললেন, তুমি যে কত বড় অন্যায় করেছ তা কি বুঝতে পারছ?
আমি বললাম, আমি কোনো অন্যায় করি নি। বাবা আমাকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন, কাজেই বের হয়ে গেছি।
বাইরে কোথাও না গিয়ে তুমি আমার এখানে চলে আসতে।
আমি বললাম, আপনার এখানে কেন আসব? আপনি আমার কেউ না।
আমি তোমার কেউ না?
না।
আহসান সাহেব বললেন, যার কাছে গিয়েছ সেও তো তোমার কেউ না।
আমি বললাম, উনি একজন লেখক, আমিও একজন লেখিকা, এই পরিচয়ে গিয়েছি। লেখকে লেখকে ধূল পরিমাণ।
বাবার সঙ্গে কী নিয়ে তোমার ঝগড়া হলো সেটা বলো।
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, আমি মাকে বলেছি আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। ঠাট্টা করে বলেছি। মা ঠাট্টাটা সত্যি ভেবে নিয়ে বাবার কাছে লাগিয়েছেন।
আমি তোমার প্রেমে পড়েছি–এই কথা বলেছ?
হ্যাঁ।
এমন একটা Absurd কথা তুমি বলতে পারলে?
ঠাট্টা করে বলেছি।
জীবনটা ঠাট্টা তামাশার ব্যাপার না। এটা মনে রাখবে।
জি আচ্ছা মনে রাখব। এখন কি বাসায় যেতে পারব?
যাও। রেস্ট নাও। মাথা ঠান্ডা করো।
আমি বাসায় গেলাম। পরদিন থেকে সব আগের মতো হয়ে গেল, শুধু আহসান সাহেবের ড্রাইভার কিসমতের চাকরি চলে গেল।
আমি স্বেচ্ছা কারাবন্দি
আমি স্বেচ্ছা কারাবন্দি। নিজের ঘরে সারা দিন কাটাই। আমার এই নতুন ঘরটা বেশ বড়, সঙ্গে বাথরুম আছে। টিভি আছে। বড় মামা তাঁর বাড়ি থেকে দুটা ডিভিডি প্লেয়ার এনেছিলেন। একটা আমি নিয়ে নিয়েছি। ডিভিডি প্লেয়ারে ছবি দেখি। ছাদে যাই না, আহসান সাহেবের ঘরে যাই না। ঠিক করেছি তিন মাস এইভাবে থাকব। তবে আহসান সাহেব ডেকে পাঠালে ভিন্ন কথা। তখন সেজেগুজে যাব। শাড়ি পরব, ঠোঁটে লিপস্টিক দেব, চোখে কাজল দেব। যারা কখনো সাজে না, তারা হঠাৎ সাজলে খুব সুন্দর দেখায়। আর আমি তো যথেষ্ট রূপবতী। মা কথায় কথায় বলেন, “আমার পরীর মতো মেয়ে। আমরা কেউ কখনো পরী দেখি নি, কিন্তু কথায় কথায় পরীর সঙ্গে তুলনা দেই। মহিলা জ্বিনকেই নাকি বলে পরী। তাই যদি হয় আমরা কেন বলি না “জ্বিনের মতো ছেলে? বিষয়টা নিয়ে আহসান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি যেদিন ডেকে পাঠাবেন সেদিনই এই প্রসঙ্গ তুলব। বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দশ দিন কেটেছে এখনো তিনি ডাকেন নি। মনে হয় ডাকবেন না। না ডাকলে নাই।
ডাকলে নাই
তাই তাই তাই ॥
দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে। মা আমার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, লিপি, খেতে আয়।
আমি বললাম, খেতে আসতে পারব না। তুমি একটা ট্রেতে করে এই ঘরে খাবার দিয়ে যাও।
কেন?
এখন থেকে আমি এই ঘর থেকে বের হব না। ঘরেই খাওয়াদাওয়া করব।
কারণ কী?
মা, আমার তিন মাসের জেল হয়েছে। এই ঘরটা হলো আমার জেলখানা।
কে তোকে জেল দিয়েছে?
আমি নিজেই নিজেকে দিয়েছি। বিনাশ্রম কারাদণ্ড।
দরজা খোল, তোর সঙ্গে কথা বলি।
আমি দরজা খুলব না মা।
কিছুক্ষণ পর সকিনা খাবার দিতে এসে মুখ বাঁকা করে হাসল। আমি বললাম, হাসছ কেন?
সকিনা বলল, হাসি না তো আপা। আমার মুখটা বেঁকা। এইজন্যে মনে হয় হাসতেছি।
আমাদের বাসায় খাবারের মান এক ধাপে অনেকটা উন্নত হয়েছে। বড় মামার অবদান। আজ দুপুরের আইটেম হলো, ছোট আলু দিয়ে কই মাছ, ইলিশ মাছ ভাজি, সরিষা বাটা দিয়ে মানকচুর একটা ঝোল। এই আইটেমটা সবচেয়ে ভালো। তিন পদের তরকারি দিয়ে আমাদের বাসায় এর আগে কখনো রান্না হতো না। এখন হচ্ছে। মাঝে মাঝে চার পদেরও হয়।
বড় মামা ভালো আছেন এবং সুখে আছেন। তিনি সারা সকাল খবরের কাগজ পড়েন। বাসায় চারটা পত্রিকা রাখা হয়। একটা ইংরেজি, তিনটা বাংলা। বড় মামা ইংরেজি পত্রিকা পড়া দূরের কথা, ভাঁজও খুলেন না। যে পত্রিকা পড়া হয় না, সেই পত্রিকা কেন রাখা হয় আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আহসান সাহেব বলেন, আমাদের পৃথিবী হলো কার্যকারণের পৃথিবী। সব ঘটনার পেছনে কারণ থাকবে। অকারণে কিছুই ঘটবে না। Cause and effect.