উনি বললেন, তুমি স্টোররুমে থাকবে, এটা আমাকে শোনাবার জন্য মিছিমিছি টেলিফোনে কথা বলেছ। ল্যান্ডফোনে সাতবার বোতাম টিপেছ।
তোমার কথা শুনে যখন ঘরের ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি, তখন আবার লেখিকা সাজছ, এইজন্য হাসছি।
আমি মুখ ভোঁতা করে বের হয়ে এলাম। আজ সোমবার বলেই যথেষ্ট লজ্জা। পেয়েছি। তবে লজ্জার সঙ্গে কিছুটা আনন্দও পেয়েছি। উনি আমাকে যথেষ্ট মন দিয়ে লক্ষ করেছেন, তা না হলে আমি যে সাতবার বোতাম টিপেছি তা ধরতে পারতেন না। আনন্দ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। হয়তো আরও ঘটবে।
.
আহসান সাহেবের লোকজন একদিনে আমার ঘর ঠিক করে দিল। ঘরে নতুন রঙ করা হলো। এসি লাগানো হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, নতুন একটা বাইশ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি চলে এল। মা অবাক হয়ে বলল, লিপি, ব্যাপার কী রে?
আমি বললাম, জানি না কী ব্যাপার। মনে হয় উনি আমার প্রেমে পড়েছেন। বুড়োরা প্রেমে পড়লে প্রেমিকার মন ভুলাবার জন্যে প্রচুর খরচপাতি করে।
মা আঁতকে উঠে বললেন, ছিঃ ছিঃ কী বলিস তুই! তওবা কর। ফেরেশতার মতো মানুষ। তোকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। তাকে নিয়ে এত নোংরা কথা। উনার কানে গেলে উনি কী ভাববেন?
রাত আটটার দিকে বাবা বাসায় এলেন। মা সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে নালিশ করলেন। বাবা বললেন, লিপি! তুই এই ধরনের কথা বলেছিস? ইয়েস অর নো? (বাবা সবসময় আমার সঙ্গে তুমি তুমি করে কথা বলেন। এখন তুই-এ নেমে এসেছেন।)
আমি বললাম, বলেছি।
বাবা বললেন, কানে ধর।
আমি বললাম, কানে ধরব না।
বাবা বললেন, এত বড় কথা তুই কোন সাহসে বললি?
আমি বললাম, ইচ্ছা হয়েছে বলেছি।
আর কখনো বলবি?
আবার যদি ইচ্ছা হয় বলব।
তোর মতো দুষ্ট মেয়ে তো আমি বাসায় রাখব না। দুষ্ট মেয়ের চেয়ে শূন্য বাড়ি ভালো। তুই এক্ষণ, এই মুহূর্তে আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবি।
আমি বললাম, Ok.
বাবা চিৎকার করে বললেন, আবার ইংরেজি বলে? গেট আউট, গেট আউট।
মা বললেন, এত রাতে কোথায় যাবে?
বাবা বললেন, সেটা আমার বিবেচ্য না। যেখানে ইচ্ছা যাবে। দুষ্ট মেয়ে আমি পুষব না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি আদর্শ নিয়ে চলি।
আমি গটগট করে তাদের সামনে থেকে বের হলাম। আহসান সাহেবের ড্রাইভার কিসমতকে বললাম, আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যান, আপনার স্যার। বলেছে।
গাড়ি নিয়ে আমি কোথায় গেলাম শুনলে অবাক হবেন, আমি গেলাম লেখক হুমায়ূন আহমেদের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে।
দারোয়ান গেটেই আটকাল। আমি বললাম, হুমায়ূন আহমেদ আমার বড় চাচা। শুনেছি উনার শরীর খারাপ, এইজন্যে দেখতে এসেছি।
দারোয়ান বলল, স্যার তো বাসায় নেই। ম্যাডামকে নিয়ে কোথায় যেন গেছেন।
আমি বললাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে চাচা কোথায় গেলেন? লেখক মানুষ, শরীর নিয়ে তাদের কারবার না, মন নিয়ে তাদের কারবার। যাই হোক, আমি অপেক্ষা করব।
দারোয়ান দামি গাড়ি দেখেই মনে হয় ছেড়ে দিল। আমি কিসমত ভাইকে বললাম, আমার বাবা-মা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। আমি এখন আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি আপনার পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছেন বলবেন না। বলবেন, আমাকে রেলস্টেশনে নামিয়ে দিয়েছেন। আমি চাই তাঁরা দুশ্চিন্তা করুক।
লেখক এবং লেখকপত্নী রাত এগারটার দিকে এলেন। এর মধ্যে আমি বেশ স্বাভাবিকভাবেই আছি। এই বাড়িতে টেলিফোন করলে যে বলত, “স্যার রেস্টে আছেন, তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সে হুমায়ুন আহমেদের পিয়ন, নাম মোস্তফা।
আমি বললাম, মোস্তফা ভাই, ভাত খাব। ঘরে তেমন কোনো খাবার না করলে ডিম ভেজে দিতে বলুন। গরম ভাত, ডিম ভাজা আর শুকনা মরিচ ভাজা। হুমায়ূন স্যারের পছন্দের খাবার। আমি তাঁর লেখায় পড়েছি।
মোস্তফা ভাই ডিম ভাজতে গেল। এই ফাঁকে আমি একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম। দেখি, লেখকের পুত্র গম্ভীর হয়ে টিভিতে কার্টুন দেখছে। আমি বললাম, তোমার নাম কী? সে বলল, আমাকে বিরাক্ত করবে না।
আমি বললাম, বিরাক্ত আবার কী?
সে বলল, বিরাক্ত হলো ডিস্টার্ব।
তোমার নামটা জানতে পারি?
নিষাদ।
নামের অর্থ জানো?
আমাকে বিরাক্ত করবে না। আমাকে বিরাক্ত করলে আমি লাগ হব। আমার অনেক লাগ।
ছেলেটা র এর জায়গায় ল বলছে, আবার বিরক্ত বলার সময় র উচ্চারণ করতে পারছে। তার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সে হাত ধরে আমাকে তার ঘরের বাইরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
.
লেখক এবং লেখকপত্নী ফিরলেন রাত এগারটায়।
আমি আয়োজন করে ভাত খাচ্ছি, লেখকপত্নী আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, তুমি কে?
আমি বললাম, আমার নাম মৃন্ময়ী।
লেখকপত্নী বললেন, আমি তো তোমাকে চিনতে পারছি না। তিনি লেখকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একে চেনো?
লেখক বললেন, না। বলেই তিনি শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। মনে হয় স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।
লেখকপত্নী বললেন, এই বাড়িতে এসেছ কেন? এখানে কী?
আমি বললাম, আমাকে বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। রাতটা আপনাদের বাসায় থাকব, ভোরবেলা চলে যাব।
লেখকপত্নী বললেন, কোথায় যাবে?
আমি বললাম, এখনো ঠিক করি নি, নাক বরাবর হাঁটা ধরব।
লেখকপত্নী (তাঁর নাম শাওন) শান্ত গলায় বললেন, তুমি খেতে বসেছ, খাও তারপর আমি নিজে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসব। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলব।