মা বাবার দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলেন টাকা না রাখতে, বাবা টাকা রাখলেন। এমন ভাব করলেন যেন চোখের ইশারা বুঝতে পারেন নি।
বড় মামা চলে যাওয়ার পর বাবা আমাকে নিয়ে বারান্দায় গেলেন, গলা নামিয়ে বললেন, ডেভেলপারের সঙ্গে তোমার মামার কী চুক্তি হয়েছে সেটা জানা দরকার। ডেভেলপাররা চুক্তির সময় ক্যাশ টাকা দেয়। সেই টাকায় তোমার মার অংশ আছে। সেই টাকা কোথায়?
আমি বললাম, এইসব আমাকে কেন বলছ? আমার সঙ্গে তো ডেভেলপারদের কোনো চুক্তি হয় নি।
বাবা বললেন, তোমার সঙ্গে শেয়ার করছি। তুমি আবার তোমার মাকে কিছু বলতে যেয়ো না। তোমার মা ভাববে আমি লোভী।
আমি বললাম, তুমি তো লোভীই। লোভী না হলে এমন চিন্তা করতে না।
বাবা বললেন, বাস্তব চিন্তা করছি। তোমার বড় মামা ধুরন্দর প্রকৃতির মানুষ। শেষে দেখা গেল তোমার মা কিছুই পেল না।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কিছু না পেলে কী আর করা!
আমার এই হাই নকল। আমি ইচ্ছা করলেই ঘনঘন হাই তুলতে পারি। কোনো আলাপ পছন্দ না হলে আমি হাই তুলি।
বাবা যে বললেন, বড় মামা ধুরন্দর প্রকৃতির, এটা ঠিক আছে। একটা ঘটনা বললেই তার প্রকৃতি বোঝা যাবে। আমার নানিজানের প্রচুর গয়না ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বড় মামা আমার মাকে বললেন, মৃত্যুর সময় মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা নষ্ট হয়ে যায়। অস্বাভাবিক কাজকর্ম করে।
মা বললেন, এই কথা কেন বলছ ভাইজান?
বড় মামা বললেন, মার কর্মকাণ্ড দেখে বাধ্য হয়ে বলছি।
মা কী করেছে?
বড় মামা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যেদিন মারা গেলেন সেদিন সকালে তোর ভাবিকে ডেকে বললেন, “বৌমা, আমার সব গয়না তোমাকে দিয়ে গেলাম। তুমি দিয়ো তোমার ছেলের বৌকে।
তোকে মা এত আদর করত, অথচ তোর কথা একবার মনেও করল না। আশ্চর্য মহিলা!
মা বলল, মাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলবে না ভাইজান। মা যা ভালো মনে করেছে করেছে।
বড় মামা বললেন, কাজটা যে অনুচিত হয়েছে সেটা বলব না? যাই হোক, আমি তোর ভাবিকে বলেছি, কিছু গয়না ফরিদাকে দিয়ো। মায়ের স্মৃতিচিহ্ন। তবে মেয়েমানুষ তো, গয়না হাতছাড়া করবে না।
এই হলো আমার বড় মামা। আমার ধারণা বড় মামা একদিন বলবে, ফরিদা! তোকে বলা হয় নাই, রামপুরার জমিটা বাবা আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন। কাজেই তোর সেখানে অংশ নাই। তারপরেও তোকে একটা ফ্ল্যাট আমি দেব।
যদি এরকম কিছু ঘটে, তাহলে আমি বড় মামাকে টাইট দেব। কীভাবে টাইট দেব তা এখনো ঠিক করি নি।
সন্ধ্যাবেলা আহসানের ঘরে গেলাম।
আহসান আহসান বলতে অস্বস্তি লাগছে, আমি আহসান সাহেবে ফিরে যাই। উনার ঘরে কোনো অজুহাত ছাড়া যাওয়া ঠিক না, আমি এক কাপ চা নিয়ে গেলাম।
আহসান সাহেব বললেন, আমি দিনে দুই কাপের বেশি চা খাই না। আজকের দিনের দুকাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে।
আমি বললাম, এটা সাধারণ চা না। এটা তুলসি চা। চা পাতার সঙ্গে তুলসি পাতা জ্বাল দিয়ে বানানো। (কথাটা মিথ্যা, সাধারণ চার মধ্যে আমি ধনিয়া পাতা দিয়েছি। ধনিয়া চা বলা যেতে পারে।)
আহসান সাহেব বললেন, তুলসি চা তো আমি আরও খাই না। তুমি খেয়ে ফেলো।
আমি আচ্ছা বলে চায়ে চুমুক দিলাম। উনি বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো কাজে এসেছ। কাজটা বলো।
আমি বললাম, আপনার মোবাইল থেকে কি একটা টেলিফোন করতে পারব? (আমার কোথাও টেলিফোন করার দরকার নেই। উনার মোবাইল কিছুক্ষণের জন্য প্রয়োজন। আসমা নামের একটা মেয়ে প্রায়ই তাকে টেলিফোন করে। উনিও করেন। আমার ওই মহিলার টেলিফোন নম্বর প্রয়োজন।)
আহসান সাহেব বললেন, মোবাইল ফোন হলো ব্যক্তিগত ফোন। এটা দেওয়া যাবে না। ল্যান্ডফোনে টেলিফোন করো।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
উনি বললেন, আমার কথা শুনে মুখ ভোঁতা করে ফেললে কেন?
আমি বললাম, আপনার কথা শুনে মুখ ভোঁতা করি নি। অন্য কারণে মুখ ভোঁতা হয়েছে।
অন্য কারণটা কী?
উপন্যাসটা লিখতে পারছি না। গল্পটা গোছানো আছে, কিন্তু লেখা আসছে না।
গল্পটা কী?
প্রেমের গল্প। বয়স্ক একজন মানুষ খুবই অল্প বয়সী একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। বুড়োটা নানান কর্মকাণ্ড করে মেয়েটাকে তার প্রেমের ব্যাপার বোঝাতে চায়, কিন্তু বোঝাতে পারে না।
কী রকম কর্মকাণ্ড?
এটা নিয়ে এখনো চিন্তা করি নি। আচ্ছা যাই।
টেলিফোন না করেই চলে যাচ্ছ?
ও আল্লাহ! ভুলে গেছি।
আমি ল্যান্ডফোন হাতে নিয়ে বসে আছি। কাকে টেলিফোন করব বুঝতে পারছি না। কাছের কারও টেলিফোন নম্বর আমার মনে নেই। আমি কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে নম্বর টিপে কারও সঙ্গে কথা বলছি এমন গলায় বললাম, মৃন্ময়ী! আমি লিপি। দুপুরে তোর ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারি নি, সরি। আমার বড় মামা আমাদের বাসায় থাকতে আসছেন। তার জন্য ঘর গুছাচ্ছিলাম। উনি থাকবেন আমার ঘরে। আমি কোথায় থাকব? এখনো ঠিক করি নি। আমাদের একটা স্টোররুমের মতো আছে, সেখানে থাকতে পারি। আচ্ছা রাখি, কাল দেখা হবে।
ফোন রেখে চলে আসছি, আহসান সাহেব বললেন, তোমাদের ফ্ল্যাটের দুইটা ঘর আমার অফিসের জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই, তার একটা খালি করে দিতে বলি, তুমি সেখানে থাকো।
আমি বললাম, না।
তিনি বললেন, না কেন?
আমি একজন লেখিকা, এইজন্য না। ক্রিয়েটিভ মানুষ কারও দয়া নেয় না।
আহসান সাহেব শব্দ করে হাসলেন। আমি বললাম, এইভাবে হাসছেন কেন?