সাইকিয়াট্রিস্ট : তুমি যে অসম্ভব রূপবতী একজন মেয়ে, এটা কি জানো?
আমি : জানি। মা আমাকে আদর করে পরী ডাকেন। তা ছাড়া নিজেও আয়নায় নিজেকে দেখি।
সাইকিয়াট্রিস্ট : দেখে মুগ্ধ হও?
আমি : হই।
সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার বান্ধবীর সংখ্যা কেমন?
আমি : আমার একজন মাত্র বান্ধবী, তার নাম প্রতিমা।
সাইকিয়াট্রিস্ট : সে কি দেখতে কদাকার?
আমি : না। অপূর্ব রূপবতী।
সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার চেয়েও?
আমি : মনে হয় সমান সমান। আপনাকে একটা কথা বলি, আমার উপন্যাসের প্রথম তিন পাতা আমার লেখা না। প্রতিমার লেখা।
সাইকিয়াট্রিস্ট; অতিরিক্ত রূপবতীরা রূপের কারণে সবার চেয়ে আলাদা হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে Alienation প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখনই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
আমি : আমার মধ্যে কোনো মানসিক সমস্যা নেই। আমার বান্ধবী প্রতিমার মধ্যে আছে। আমি কি তাকে নিয়ে আপনার কাছে আসতে পারি?
সাইকিয়াট্রিস্ট : পারো।
বাসায় ফিরলাম রাত সাড়ে নটায়। বাবা তখনো ফিরেন নি। মা এবং বড় মামা বসে আছেন। দুজনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। বড় মামা বললেন, লিপি, কোথায় গিয়েছিলে?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আহসান সাহেবের সঙ্গে লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম।
বড় মামা বললেন, তুমি বসো এখানে। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
আমি বললাম, এক মিনিট মামা। আসছি। বলেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বাতি অফ করে দিলাম।
সোমবার আমার জন্যে অশুভ
সোমবার আমার জন্যে অশুভ। শুধু অশুভ বললে কম বলা হবে, ভয়ংকর ভয়ংকর অশুভ। এমন কোনো সোমবার যায় নি যেদিন আমার জীবনে খারাপ কিছু ঘটে নি।
আজ যে সোমবার মনেই ছিল না। মা যখন বললেন, লিপি, তোর ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। তখনই মনে হলো, আজ সোমবার না তো! মাকে বললাম, আজ কি সোমবার?
মা বললেন, সোমবার মঙ্গলবার জানি না। তুই ঘরের জিনিসপত্র বের করে ফেল।
আমি গলা স্বাভাবিক করে বললাম, কেন?
মা আনন্দিত গলায় বললেন, তোর বড় মামা এই ঘরে থাকবে।
তাঁর না হোটেলে ওঠার কথা?
নিজের বোনের বাড়ি থাকতে সে হোটেলে কেন উঠবে?
বড় মামার আমাদের বাসায় এসে ওঠার কারণটা বলি। রামপুরায় তাঁর বাড়ি আছে। পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়ি। অনেক দিন থেকেই ডেভেলপারের সঙ্গে বড় মামা দেনদরবার করছিলেন। তারা পুরনো বাড়ি ভেঙে দশতলা বাড়ি করবে। তারা কিছু নেবে, বড় মামা কিছু পাবেন। ডেভেলপারদের সঙ্গে দরে বনছিল না। এখন মনে হয় বনেছে।
আমি বললাম, আমি কোথায় থাকব?
তুই পুবের ঘরে থাকবি।
পুবের ঘরটা তো স্টোররুম।
জিনিসপত্র সরিয়ে ফেললেই সুন্দর ঘর হবে। আমি গুছিয়ে দেব। জানালায় নতুন পর্দা দেব।
মার আনন্দে ঝলমল মুখ দেখে আমি নিজের কষ্ট ভুলে গিয়ে এমন ভাব করতে থাকলাম যেন বড় মামা আসায় আমিও খুশি। আনন্দ রাখার জায়গা পাচ্ছি না। এমন অবস্থা।
এখন মার খুশির কারণ ব্যাখ্যা করি। ডেভেলপাররা যে ফ্ল্যাটবাড়ি করবে মা সেখান থেকে ওয়ারিশান সূত্রে ফ্ল্যাট পাবে। আমার দুই মামা। ছোট মামা কলেজে পড়ার সময় কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন। এখন বড় মামা। ও মা এই দুজনই শুধু নানাজানের সম্পত্তির মালিক।
বড় মামার দুই ছেলে এবং এরা দুজনই অস্ট্রেলিয়ায়। ইন্ডিয়ান কী এক রেস্টুরেন্টে কাজ করে। মামিও ছেলেদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মামা-মামির সম্পর্ক ভয়ানক খারাপ।
আমি, মা আর সকিনা মিলে বিকেলের মধ্যে মামার ঘর গুছিয়ে ফেললাম। বাবা নিজেই প্লাস্টিক পেইন্ট করলেন। এইসব কাজ তিনি ভালো পারেন।
বড় মামা সন্ধ্যাবেলায় একটি এসি নিয়ে উপস্থিত হলেন। যে ঘরে তিনি থাকবেন সেখানে এসি বসবে। তিনি গরম সহ্য করতে পারেন না। এসির সঙ্গে মিস্ত্রি এসেছে। সে এক ঘণ্টার মধ্যে এসি বসিয়ে দিল।
আমার পরিচিত ঘরটা চোখের সামনে অন্যরকম হয়ে গেছে। ঘরের দেওয়াল হালকা নীল। এই গরমেও ঘর শীতকালের মতো ঠান্ডা। বিছানায় নতুন চাঁদর। একটা কোলবালিশও কেনা হয়েছে। খাটের পাশে বেডসাইড কার্পেট দেওয়া হয়েছে। নতুন দেয়ালঘড়ি লাগানো হয়েছে।
বড় মামা তার ঘর দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মাকে বললেন, সব ঠিক আছে। আজ আর উঠব না। ঘরে কাঁচা রঙের গন্ধ। গন্ধটা মরুক। নতুন একটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি কিনব। আগেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি ওঠানামা করে।
মা বলল, ভাইজান, আর কী কী লাগবে বলুন, আমি ব্যবস্থা করব।
বড় মামা বললেন, তোকে কিছুই ব্যবস্থা করতে হবে না। ব্যবস্থা যা করবার আমিই করব। এখন আমার কিছু কথা মন দিয়ে শোন, সকালে আমি চার-পাঁচটা পত্রিকা পড়ি। পত্রিকার নাম দিয়ে যাব, হকারকে পত্রিকা দিতে বলবি। পত্রিকার বিল আমি দেব।
মা বললেন, আপনি কেন দেবেন?
বড় মামা বললেন, তোদের অবস্থা আমি জানি, এইজন্যে আমি দিব। শুধু পত্রিকার বিল না, মাসে এক হাজার করে টাকা দিব। মাসের এক তারিখে সারা মাসের চাল ডাল তেল মসলা কিনে দেব।
বাবা বললেন, ভাইজান, এইসব কী বলেন?
পেইংগেস্টরা যে রকম থাকে আমি সেই রকম থাকব। এই বিষয়ে আর কোনো কথা শুনব না।
বড় মামা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন। সেখান থেকে এক হাজার টাকার দুইটা চকচকে নোট বের করে বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ঘর ঠিক করেছ, খরচপাতি হয়েছে, এই টাকাটা রাখো।