আমি বললাম, চিঠি সঙ্গে এনেছিস?
প্রতিমা বলল, হু। চিঠি পড়াতেই তো এসেছি।
তাহলে দে, পড়ি।
তুই যদি প্রমিজ করিস উপন্যাসের শুরুটা আমাকে লিখতে দিবি, তাহলে পড়তে দেব।
আচ্ছা যা, তোকে লিখতে দেব।
প্রতিমা চিঠি বের করল। দ্বিতীয় চিঠি প্রথমটার চেয়েও ভয়ংকর
ও আমার লুতু লুতু পুতুপুতু গুতু গুতু সোনা। তুমি কেমন আছ লক্ষ্মী? তুমি আমার পক্ষী।
আচ্ছা পুতু পুতু গুতু গুতু, শোনো। তুমি তোমার পাছাটা এত বড় কীভাবে বানিয়েছ? নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো এক্সারসাইজ করো।
আমার কথায় আবার রাগ করছ না তো? তুমি রাগ করলে আমি কিন্তু মরেই যাব।
.
প্রতিমা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল, আমার উপন্যাসের শুরুটা লিখে দিয়ে গেল। ভয়ংকর এক শুরু।
নগ্ন নায়িকার ঘরে ঢুকেছে ইমন (শুভ্র নাম বদলে ইমন রাখা হয়েছে)। ইমন চট করে দরজা লক করে দিল, কিন্তু বারান্দার জানালাটা রইল খোলা। খোলা জানালা দিয়ে শুধু যে দাঁড়কাক সব দেখছে তা না, শব্দ শুনে একসময় মা এসে জানালা দিয়ে দেখেন তার মেয়ে এবং ইমন আছে 69 অবস্থায়।
আমি প্রতিমাকে বললাম, 69 কী?
প্রতিম হাই তুলতে তুলতে বলল, তোর বোঝার দরকার নেই। যাদের বোঝার তারা ঠিকই বুঝবে।
প্রতিমা চলে যাওয়ার পরে আমি পুরো লেখাটা কপি করে আহসান সাহেবের কাছে গেলাম। আজ তাঁর মেজাজ খুবই ভালো। তিনি আমাকে দেখেই হাসিমুখে বললেন, Hello friend!
আমি হাসলাম। অন্য রকম হাসি। ঠোঁটের এক কোনায় হাসতে হয়।
আহসান সাহেব বললেন, হাতে কাগজ কিসের? উপন্যাস?
জি। শুরুটা লিখে ফেলেছি।
কেমন হয়েছে?
বুঝতে পারছি না, এইজন্যে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। পড়ে দেখুন।
আহসান সাহেব পড়ছেন। আমি তার সামনে বেতের চেয়ারে ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারি না টাইপ মুখ করে বসে আছি। মাঝে মাঝে ঠোঁট গোল করে শিস দেওয়ার চেষ্টা করছি। শিস হচ্ছে না। প্রতিমা খুব সুন্দর শিস দিতে পারে। তার কাছে থেকে শিখতে হবে।
লিপি।
জি।
আহসান সাহেব হাতের লেখা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ এক কিশোরী। তোমার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।
কী চিকিৎসা?
সাইকিয়াট্রিস্ট ঠিক করবেন কী চিকিৎসা। আমার পরিচিত সাইটেকিয়াট্রিস্ট আছেন। আমি তোমাকে সঙ্গে করে তার কাছে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?
হ্যাঁ, ঠিক আছে। কবে নিয়ে যাবেন?
এখনই নিয়ে যেতে পারি। সে রাত নটা পর্যন্ত রোগী দেখে। এখন সময় হলো সাড়ে সাত। টেলিফোন করে দেখি সে আছে কি না।
টেলিফোনে সাইকিয়াট্রিস্টকে পাওয়া গেল।
আহসান সাহেব অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। আমাকে বললেন, তুমি ড্রেস পাল্টালে পাল্টাও। মাকে বলে আসো।
কী বলব? পাগল হয়ে গেছি তো, তাই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছি?
এইসব বলার দরকার নেই। বলো যে আমার সঙ্গে শপিংয়ে যাচ্ছ। এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরবে।
আমি ড্রেস বদলে শাড়ি পরলাম। চোখে কাজল দিলাম।
মা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে?
আমি বললাম, ব্যাপার জানি না। আহসান সাহেব আমাকে তার সঙ্গে যেতে বললেন। আচ্ছা মা শোনো, উনি যদি আমাকে কোনো হোটেলে নিয়ে যেতে চান তাহলে কী করব?
মা আতংকে অস্থির হয়ে বললেন, হোটেলে কেন নিয়ে যাবে?
আমি গালে পাউডার ঘষতে ঘষতে বললাম, বুড়োরা তরুণী মেয়েদের হোটেলে কেন নিতে চায় তুমি জানো না?
তোর বাবা বাসায় নেই। তাঁকে না জানিয়ে আমি তোকে আহসান সাহেবের সঙ্গে ছাড়ব না।
আমি বললাম, এই কথা আমি উনাকে বলতে পারব না। তুমি বলে আসো। তুমিও পারবে না। আশ্রিতদের এই হলো সমস্যা।
মা ক্ষীণ গলায় বললেন, আমরা আশ্রিত?
আমি বললাম, অবশ্যই।
.
সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেবকে দেখে আমার ভালো লাগল। পঞ্চাশের মতো বয়স। মাথাভর্তি সাদা-কালো মেশানো চুল। নাকের নিচে আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো গোঁফ। ভারী কাঁচের চশমার আড়ালে বড় বড় চোখ। তিনি পরেছেন সিল্কের হাফ হাওয়াই শার্ট। হুমায়ূন স্যারের মিসির আলির চেহারা হয়তো এই দ্রলোকের মতো। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম আশফাঁক। মনোবিদ্যায় তাঁর Ph.D ডিগ্রি আছে।
তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন (কথোপকথনের সময় আহসান সাহেবকে বাইরে রাখা হলো)।
সাইকিয়াট্রিস্ট : মা। কেমন আছ?
আমি : (শুরুতেই মা ডাকায় আমি বেশ চমকেছি। ভেবে রেখেছিলাম উল্টা পাল্টা কথা বলে সাইকিয়াট্রিস্টকে ভড়কে দেব। এখন মনে হচ্ছে পারব না। যে শুরুতেই মিষ্টি করে মা ডাকে, তার সঙ্গে উল্টা-পাল্টা কথা বলা যায় না।)।
সাইকিয়াট্রিস্ট : প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন? তুমি কেমন আছ?
আমি : চাচা। আমি ভালো আছি।
সাইকিয়াট্রিস্ট : কতটা ভালো? খুব বেশি, না মোটামুটি ভালো?
আমি : মোটামুটি।
সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার উপন্যাসের প্রথম তিন পাতা আমি পড়েছি। মা, বলো তো তোমার জীবনে কি এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে?
আমি : না।
সাইকিয়াট্রিস্ট : তোমার মধ্যে কি কোনো পাপবোধ আছে?
আমি : না।
সাইকিয়াট্রিস্ট : কারও প্রতি কি তোমার রাগ আছে? প্রচণ্ড রাগ। খুন করতে। ইচ্ছা হয়, এমন?
আমি : আছে। আমার বড় মামার প্রতি আছে।
সাইকিয়াট্রিস্ট : তার প্রতি রাগের কারণটা বলো তো শুনি।
আমি : বলব না। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।
সাইকিয়াট্রিস্ট : মা শোনো। আমি তোমার ডাক্তার। ডাক্তারকে সব বলতে হয়।
আমি : যখন ছোট ছিলাম, আট ন বছর বয়স, তখন মামা খেলার ছলে আমার শরীরের নানান জায়গায় হাত দিতেন। খুবই অস্বস্তি বোধ করতাম। মামা কেন এরকম করছেন বুঝতাম না। এখন বুঝি।