- বইয়ের নামঃ দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আমার নাম লিপি
দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
হুমায়ূন আহমেদ
আমার নাম লিপি। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সায়েন্স গ্রুপ। স্কুলের নাম লালমাটিয়া গার্লস হাই স্কুল। আমি ঠিক করেছি গরমের ছুটিতে একটা উপন্যাস লিখব। উপন্যাসের নাম মাঝে মাঝে তব দেখা পাই। নামটা সুন্দর না? তবে এই নাম আমার দেওয়া না। নাম দিয়েছেন আহসান সাহেব। আহসান সাহেব আমাদের বাড়িওয়ালা। তিনতলায় থাকেন। তাঁর অনেক বুদ্ধি। উপন্যাস লেখার আইডিয়াও তিনি দিয়েছেন। আমার ধারণা তিনি সিরিয়াসলি এই আইডিয়া দেন নি। ফাজলামি করে দিয়েছেন। তিনি অনেক ফাজলামি করেন। মুখ গম্ভীর করে ফাজলামি করেন বলে বোঝা যায় না। তিনি অনেক রসিকতাও করেন। সর্দারজিদের নিয়ে তার একটা গল্প আছে। যতবার এই গল্পের কথা আমার মনে হয় ততবারই আমি একা একা হাসি। তাঁর সম্পর্কে আমি পরে লিখব। এখন উপন্যাসটা সম্পর্কে বলি।
আচ্ছা সর্দারজির জোকটা বলে নেই, পরে ভুলে যাব। যে-কোনো মানুষকে একটা পাতা ফটোকপি করতে দিলে পাঁচ মিনিটে ফটোকপি করে নিয়ে আসে, শুধু সর্দারজিরা এক ঘণ্টা সময় নেন। কারণ তারা মূল পাতার সঙ্গে ফটোকপি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলিয়ে দেখেন–সব বানান ঠিক আছে কি না।
আহসান সাহেব বলেছেন, উপন্যাসের শুরুর কয়েকটা লাইনে কোনো-না কোনো চমক থাকতে হবে। যেন পাঠক প্রথম কয়েকটা লাইন পড়েই হুকড হয়ে যায়। অর্থাৎ বরশিতে আটকে যায়। মনে মনে বলে, ঘটনাটা কী? উপন্যাসের ওপেনিং আর দাবার ওপেনিং এক না। দাবার ওপেনিং নির্দিষ্ট হয় PK4 কিংবা PQ3। উপন্যাসের ওপেনিং নির্দিষ্ট না। তুমি যে-কোনো জায়গা থেকে শুরু করতে পারো। তবে শুরুতেই থাকবে চমক।
আমি বললাম, চমক একটা সস্তা বিষয় না?
উনি বললেন, সেটা নির্ভর করে চমকটা কে দিচ্ছে তার ওপর। দস্তয়েভস্কির চমক আর চাঁদপুরের ঔপন্যাসিক মোঃ শাহজাহান মিয়া বাবলুর চমক এক হবে না।
আমি বললাম, মোঃ শাহজাহান মিয়া বাবলুটা কে?
সে কেউ না, সে exist করে না। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ঔপন্যাসিকের উদাহরণ হিসেবে তাকে এনেছি। বুঝেছ My friend?
আমি বললাম, Yes friend.
আহসান সাহেবের মেজাজ যেদিন খুব ফুরফুরে থাকে সেদিন আমাকে My friend ডাকেন।
সমস্যা হচ্ছে বেশির ভাগ সময় তার মেজাজ থাকে খারাপ। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে কুৎসিত ব্যবহার করেন। একবার আমাকে বললেন, তোমার মধ্যে বাঁদর ভাব আছে, এই তথ্য কি জানো?
আমি বললাম, না।
তিনি বললেন, বাঁদর প্রজাতির আছে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অসীম কৌতূহল। এবং অস্থির স্বভাব। তোমারও তাই।
আচ্ছা এই প্রসঙ্গ এখন থাক। আমি আমার উপন্যাসের শুরুটা দুইভাবে ভেবে রেখেছি। কোনটা রাখব এখনো ঠিক করি নি। দুটোতেই চমক আছে। যেমন–
(ক) আমার পাশের ঘরে কে যেন গোঁ গোঁ শব্দ করছে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে কাউকে ছুরি দিয়ে গলা কাটা হচ্ছে।
(খ) ঠিক দুপুরে একটা দাঁড়কাক এসে বসল আমাদের রেলিংয়ে। বসেই সে মানুষের গলায় ডাকল, কে আছ? কে?
দুটা শুরুতেই চমক আছে, তবে শেষেরটায় চমক একটু বেশি। প্রথমটায় ডিটেকটিভ উপন্যাস ভাব আছে। আমি ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখব না, প্রেমের উপন্যাস লিখব। মনে হয় আমি কাকের মানুষের মতো কথা বলাটা রাখব। কাক তো আর মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। কাজেই তার একটা ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এমন হতে পারে যে, কাক কা কা করছে, সবাই ভুল শুনছে।
আহসান সাহেব বলেছেন, তোমাকে চরিত্র বর্ণনা করতে হবে। পুরোটা না হলেও কিছুটা। মনে করো, তুমি তোমার বাবার সম্পর্কে লিখছ। তোমার বাবা দেখতে কেমন এটা লিখতে হবে। যেন পাঠক তোমার বাবা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পায়। তারা উনার একটা ছবি কল্পনা করতে পারে। তোমার বাবা কত ফুট কত ইঞ্চি লম্বা এটা বলার দরকার নেই। তবে তিনি লম্বা না খাটো–এটা বলতে হবে। তার ওজন কত পাউন্ড কত আউন্স বলতে হবে না। তিনি রোগা না মোটা এটা বলা দরকার। তিনি কী ধরনের কাপড় পরেন তা লিখতে পারো। সাধারণত যে সব বর্ণনা লেখকরা এড়িয়ে যান তা দিতে পারো। যেমন, কী জুতা পরেন এবং জুতার ফিতা কীভাবে বাঁধেন।
আমি বললাম, জুতার ফিতা বাঁধাও লিখতে হবে?
তিনি বললেন, লিখতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে তুমি যদি লেখো তাহলে পাঠক ভাববে, এই লেখকের Power of observation তো ভালো। তারা আগ্রহ নিয়ে তোমার লেখা পড়বে। বুঝেছ?
আমি বললাম, Yes sir. : তিনি, সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এখন তোমার Power of observation-এর . পরীক্ষা। বলো দেখি, আমি যখন বাইরে যাই তখন কোন ধরনের জুতা পরি?
আমি বললাম, আপনি বাইরে যাওয়ার সময় কখনো জুতা পরেন না। স্যান্ডেল সু পরেন। আপনার ছয় থেকে সাত জোড়া জুতা আছে। আমি আপনাকে কখনো জুতা পরতে দেখি নি।
তিনি বললেন, ভেরি গুড!
আহসান সাহেবের কথা মেনে লিখতে হলে দাঁড়কাকটার বিষয়ে আরও কিছু লেখা দরকার। আমি লিখতে পারছি না। কারণ দাঁড়কাক আমি কখনো ভালোমতো দেখি নি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় একটা দাঁড়কাক সত্যি সত্যি। আমাদের বাসার রেলিংয়ে বসে কা কা করে ডাকত। মা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, কাক ডাকতেই আমরা যেন তাড়াবার ব্যবস্থা করি। কাকের ডাক খুবই অলক্ষণ। মার কথা সত্যি হতেও পারে। কাক ডাকাডাকির কিছুদিনের মধ্যেই আমার দাদি মারা গেলেন। কাক ডাকাও বন্ধ। অনেক দিন কাক ডাকছে না। মনে হয় খুব শিগগিরই আমাদের বাসায় কেউ মারা যাচ্ছে না। : আমার দাদির নাম মর্জিনা বিবি। যৌবনকালে তিনি কেমন ছিলেন, আমি জানি না। তখন তো তাঁকে দেখি নি। মৃত্যুর সময় তার চেহারা ডাইনি বুড়ির মতো হয়ে গিয়েছিল। গর্ত গর্ত চোখ। চামড়া শুকিয়ে প্লাস্টিকের মতো হয়ে বিকট। দেখাত। মাথায় চুল ছিল না। শুধু ডানদিকের কানের কাছে এক গোছা পাটের মতো চুল। চুলের এই গোছা তিনি খুবই যত্ন করতেন। নিজের হাতে তেল দিতেন। কাঠের চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতেন। একদিন দেখি বেণিও করেছেন।