পাঁচটা বেজে গেছে–চলুন উঠি।
তুমি আগে যাও, আমি পরে আসছি।
কেউ দেখে ফেলবে সে জন্যে?
লোকটি তার জবাব দিল না। তিথি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি কি আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেন? আমি এসএসসি পাস করেছি।
কি রকম চাকরি?
যে কোন চাকরি। টাইপিস্টের চাকরি বা এই জাতীয় কিছু।
টাইপিং জানো?
জি-না। তবে আমি শিখে নিতে পারব। আমি খুব দ্রুত শিখতে পারি।
আমার কাছে কোনো চাকরি নেই। আমার অফিসে অল্প কিছু কর্মচারী আছে নতুন লোক নেওয়ার অবস্থা অফিসে নেই। তাছাড়া…
তাছাড়া কি?
হঠাৎ করে সুন্দরী একটা মেয়েকে চাকরি দিলে নানান কথা উঠবে। আমার স্ত্রী শুনতে পেলে মনে কষ্ট পাবে। আমাকে অবশ্যি কিছু বলবে না।
ছাদ থেকে লাফিয়েও পড়তে পারে, তাই না?
লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে নিচু গলায় বলল, এইখানে ঠিকানা আছে, দবির উদ্দিন বি.এ। দবির ইন্ডাস্ট্রিজ ৩১/৩ জিগাতলা, তুমি মাস তিনেক পর একবার খোঁজ নিও।
মাস তিনেক পর খোঁজ নিতে বলছেন কেন? আপনার কি ধারণা মাস তিনেকের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর ভালমন্দ কিছু হয়ে যাবে?
লোকটি শীতল গলায় বলল, তোমাকে যতটা ভাল মেয়ে আমি ভেবেছিলাম ততটা ভাল তুমি না। তোমার মত মেয়ে যে রকম সাধারণত হয় তুমিও সেই রকমই। আলাদা কিছু না।
তিথি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, আমাকে রাগিয়ে দেয়াটা কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। কার্ডে আপনার বাসার ঠিকানা আছে। সেই ঠিকানায় যদি হঠাৎ উপস্থিত হয়ে যাই তখন কি হবে?
দবির উদ্দিন জবাব দিল না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
তিথির ঠোঁটে এখন আর হাসি নেই। সে কৃঠিন চোখে তাকাচ্ছে। দবির এই মেয়েটির দ্রুত ভাবান্তরের রহস্য ধরতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
তিথি নিচু গলায় বলল, পুরো টাকাটা জলে ফেলবেন কেন? কিছুটা অন্তত উসুল হোক। ব্লাউজ খুলে ফেলছি, আপনি আমার বুকে হাত দিন। আর যদি তাও না চান অন্তত তাকিয়ে দেখুন। আপনার অসুস্থ স্ত্রীর বুক নিশ্চয়ই আমার বুকের মত সুন্দর না।
দবিরের চেহারা ছাইবৰ্ণ হয়ে গেছে। সে অল্প অল্প কাঁপছে। তিথির মুখের কঠিন ভাজগুলি হঠাৎ সতেজ হয়ে গেল। সে বলল, আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি চমৎকার মানুষ। চলুন, আমরা যাই।
বাড়িটা ইসমাইল সাহেবের
হীরুকে ঘণ্টাখানিক ধরে একতলা একটা টিনের ঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যাচ্ছে। এই এক ঘণ্টায় বাড়ির কাছাকাছি এসে কয়েকবার তীক্ষ্ণ শিস দিয়েছে। দুবার ইটের টুকরা টিনের চালে ফেলেছে। এসব হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। চেষ্টায় কোনো ফল হচ্ছে না। কেউ বেরুচ্ছে না বা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে না।
বাড়িটা ইসমাইল সাহেবের।
ইসমাইল সাহেব মীরপুর কৃষি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। তাঁর ছয় মেয়ে। এই ছ’মেয়ের তৃতীয়জনের নাম এ্যানা। এ্যান্য এই বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্ট হয়নি। এখন রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষার কাল চলছে। হীরুর শিস এবং চালে ঢিল সবই এ্যানার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় দফায় ঢিল এবং শিস দেবার সঙ্গে সঙ্গে বসার ঘরের একমাত্র খোলা জানালাটাও বন্ধ হয়ে গেল। হীরু চাপা গলায় বলল, হারামজাদী। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। এ্যানার কাণ্ডকারখানা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। হারামজাদী আজ বেরুচ্ছে না কেন? বাবা বাসায় আছে নাকি?
হীরু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরপর তিনটা স্টার সিগারেট খেয়ে ফেলল। বুক পকেটে একটা বিদেশী ফাইভ ফাইভ আছে। সে ঠিক করে রেখেছিল–এ্যানা বের হলে এটা ধরানো হবে। এখন মনে হচ্ছে হারামজাদী বেরুবে না। অবশ্যি তার হয়ত দোষ নেই। ছোটলোক বাপ হয়ত ঘরে বসে। আছে। এই ছোটলোকটা প্রায়ই অফিস কামাই করে। ঘরে বসে বসে ঝিমায়। যার ছটা মেয়ে এবং সাত নম্বর মেয়ে স্ত্রীর পেটে বড় হচ্ছে তার বিমানো ছাড়া গতি কি? হীরু কয়েকবার দেখেছে এ্যানার মাকে। রোগা কাঠি। শ্যাওড়া গাছের ডালে এলোচুলে বসে থাকলেই এ মহিলাকে বেশি। মানাতো। তা না করে তিনি কল্যাণপুরের একটা টিনের ঘরে বাস করেন এবং ভাঙা গলায় সারাক্ষণ ছয় কন্যাকে বকাঝকা করেন। হীরু নিজেও একবার বিকা খেয়েছে।
এ্যানাদের বসার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে একবার ছোট্ট করে শিস দিতেই এই মহিলা জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, এই ছেলে তুই কি চাস?
হীরু হতভম্ব!
এই যুগে তার বয়েসী কোনো ছেলেকে কোনো মেয়ের বা যে তুই করে বলতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি। সে এতই অবাক হল যে মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ভদ্রমহিলা তার ভাঙা গলায় তিনবার বললেন, চাস কি তুই? রোজ জানালার সামনে শিস! জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
হীরু থেতমত খেয়ে বলল, কিছু চাই না ম্যাডাম। একটা অ্যাডড্রেস খুঁজছি। সতের বাই তিন। ইকবাল সাহেবের বাসা। এটা কি ইকবাল সাহেবের বাসা?
মহিলা খট করে জানালা বন্ধ করে দিলেন। হীরুর প্রায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত অবস্থা। একি যন্ত্রণা!
এই বাড়ির মেয়েগুলিও হয়েছে মায়ের মত। সব কটা মেয়ে পুরুষদের মত গলায় কথা বলে। চেহারাও পুরুষদের মত। হাবভাবও সে রকম। হীরু যে এদের একজনের জন্যে রোজ এতটা সময় নষ্ট করে এতেই এদের কৃতাৰ্থ থাকা উচিত। হীরুর ধারণা নরম্যাল পদ্ধতিতে এদের একটারও বিয়ে হবে না। প্ৰেম-টেমা করে যদি দু’একটা পার পায়। অথচ বাপ-মা এই জিনিসটাই বুঝে না।