হীরু মায়ের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। মিনু একবার বললেন, তুই আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছিস কেন?
এমনি আসছি।
না, তুই আসবি না।
আরে কি মুশকিল, এটা পারলিকের রাস্তা। যার খুশি যাবে। যার খুশি যাবে না। তুমি বলার কে?
বলছি তো তুই আমার সঙ্গে আসবি না।
আরে এ তো বড় যন্ত্রণা দেখি, বাজারে গিয়ে টুকুর খোঁজখবর করব না? সারা রাত ধরে একটা ছেলে মিসিং। চিন্তা হয় না?
আমি দাঁড়াচ্ছি। তুই যা। তুই যাবার পর আমি যাব। সঙ্গে সঙ্গে যাব না।
আমি সঙ্গে গেলে কি তোমার মান যাবে নাকি? কি মুশকিল–এরকম করে তাকাচ্ছ কেন? আচ্ছা বাবা চলে যাচ্ছি। নো হার্ড ফিলিংস।
হীরু চলে যাবার পরও তিনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঁচা রাস্তা পানিতে ডুবে গেছে। বাজারে রওনা হয়েছেন। খালি পায়ে। থকথকে নোংরা কাদায় পা ফেলে যেতে হচ্ছে। এককালে তার শুচিবায়ুর মত ছিল। নোংরা দেখলেই গা ঘিনঘিন করত। যে শাড়ি পরে রাতে ঘুমুতেন ভোরবেলা উঠেই সেটা খুলে ফেলতেন। কোথায় গেছে শুচিবায়ু। এখন নোংরা আবর্জনা পাশে নিয়েও হয়ত ঘুমুতে পারবেন।
তিথি বেরুচ্ছিল। জালালুদ্দিন বললেন, তুই বাইরে যাচ্ছিস? অর্থহীন কথা। জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু তিথি বলল, হুঁ।
আমার চোখটা বেশ ভালই লাগছে। রোদের দিকে তাকাতে পারছি। পদ্মমধু জিনিসটা অসাধারণ।
তিথি কিছু বলল না। জালালুদ্দিন বললেন–একটু দেখ তো মা–হীরু মনে হয় সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছে। প্যাকেটটা দিয়ে যা। সিগারেট জিনিসটা খারাপ হলেও মাঝে মাঝে মেডিসিনের মত কাজ করে। সব খারাপ জিনিসের একটা ভাল দিক আছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না–এভরি ক্লাউড হ্যাঁজ এ সিলভার লাইনিং।
হীরু সত্যি সত্যি প্যাকেট ফেলে গেছে। বেশ দামি সিগারেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস। চারটা সিগারেট আছে। জালালুদ্দিন একটা ধরলেন। তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিথি শীতল গলায় বলল, টুকু যে বাড়ি ফিরেনি তুমি জানো?
জানব না কেন, জানি।
চিন্তা লাগছে না তোমার?
চিন্তা তো লাগছেই। চিন্তা লাগবে না কেন? খুবই চিন্তা লাগছে।
দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সুখেই আছ।
চিন্তা করে হবেটা কি? হীরুর বেলায় তো কম চিন্তা করিনি। তাতে লাভটা কি হয়েছে?
তা ঠিক। কোনো লাভ হয়নি।
মাঝে মাঝে তোর বেলায়ও তো এরকম হয়। রাতে বাড়ি ফিরিস না। তোর বেলাতেই যদি…।
জালালুদ্দিন কথা শেষ করলেন না। তার সিগারেট নিভে গিয়েছিল। তিনি সিগারেট ধরাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিথি বলল, আমি যাচ্ছি। বাবা। ভয় নেই। রাতে ফিরে আসব। তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। তিনি তার জবাব দিলেন না। সিগারেটটা ধরছে না। এত দামি সিগারেট অথচ বর্ষায় কেমন ড্যাম্প মেরে গেছে। চুলার পাশে রেখে দিলে হত। সিগারেটের সঙ্গে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। তিথিকে বললে লাভ হবে না। সে এখন আর রান্নাঘরে ঢুকবে না। মিনু কখন ফিরবে কে জানে। বাজারে গেলে ফিরতে দেরি করে।
তিথি এখনো যায়নি। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জালালুদ্দিন চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তবু তার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। চেহারা কেমন মায়া মায়া। তবে স্বভাব কঠিন হয়েছে। বয়সকালে এই মেয়ে তার মায়ের চেয়েও কঠিন হবে। তিথি বলল,
বাবা।
কি?
তোমাকে একটা কথার কথা জিজ্ঞেস করি–ধর, আমি যদি কোনোদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যাই এবং আর ফিরে না আসি তা হলে কি হবে?
জালালুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন কোথায় যাবি তুই? এসব কি ধরনের কথা?
তিথি জবাব না দিয়ে উঠোনে নামলো। উঠোনে অনেক পানি। স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিতে হয়েছে। অসম্ভব কাদা। বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত খালি পায়ে যেতে হবে। কি বিশ্ৰী অবস্থা।
সব পুরুষকেই এক রকম মনে হয়
তিথি কখনো তার সঙ্গের পুরুষের দিকে ভাল করে তাকায় না। সব পুরুষকেই তার কাছে এক রকম মনে হয়। একদল কদাকার হাঁসের ছানার মত। সব একই রকম। কাউকে আলাদা করা যায় না। তবে তিথি তার আজকের সঙ্গীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। যদিও খুঁটিয়ে দেখার মত কিছু এই লোকটির নেই।
এর বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। কিছু বেশিও হতে পারে। গোঁফ অর্ধেকের বেশি পাকা–অবশ্যি মাথার চুল পাকেনি। হয়ত মাথায় কলপ দিয়েছে। গোঁফে দেয়নি। কিংবা দিয়েছিল–বারবার ধোবার কারণে উঠে গেছে। লম্বাটে মুখ। খুব খাড়া নাক। চোখে বেমানান এক চশমা। চশমা সাধারণত চোখের সঙ্গে লেগে থাকে–নাকের কারণে এর চোখ চশমা থেকে অনেকখানি দূরে। লোকটির মাথার চুল খুব পাতলা। কপালের অনেকখানি পুরোপুরি ফাঁকা। হয়ত আগে কখনো অপরিচিত মেয়ে নিয়ে বের হয়নি। এই ধরনের পুরুষ বেশ ভাল। এরা কিছুতেই জড়তা কাটাতে পারে না। অসম্ভব ঘাবড়ে যায়। এবং এক সময় বিব্রত গলায় বলে, তুমি চলে যাও আমার কিছু লাগবে না। কেউ কেউ আবার হঠাৎ করে মহাপুরুষ সেজে ফেলে। গাম্ভীর গলায় বলে, তোমার মত মেয়ে এই লাইনে কেন? এই সব ছেড়ে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হও। এখনো সময় আছে। তারপর বলে বাড়িতে আছে কে? ফ্যামিলি মেম্বার কত? এই লাইনে আসবার কারণটা কি? না–সোসাইটিটা একবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই লম্বামুখো মানুষটা কি বলবে কে জানে। উদ্ভট কিছু করবে কি? বিচিত্র নয়। নার্ভাস ধরনের পুরুষ প্রায় সময়ই উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করে। বুড়ো ধরনের এক লোক একবার কাঁদো কাঁদো। গলায় বলল–কিছু মনে করো না। তুমি আমার মেয়ের মত। বিশ্ৰী অবস্থা। এ জাতীয় বিশ্ৰী অবস্থা মনে হচ্ছে এবারও হবে।