আমার সামনে থেকে যা, বকবক কারিস না। মাথা ধরেছে।
যার কাছেই যাই সেই বলে সামনে থেকে যা। আমি যাবটা কোথায়? এক’দিন বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাব তখন বুঝবি।
চলে যা। তোকে ধরে রাখছে কে?
যাবই তো। কয়েকটা দিন। জাস্ট ফিউ ডেজ। এক’দিন হঠাৎ দেখরি ফুচুং। পাখি নেই। নো বার্ড।
হীরু সিগারেট ধরাল। সিগারেটের আলোয় দেখা গেল সে দাড়ি কেটে ফেলেছে। তবে গোঁফ এখনো আছে। তিথি বলল, তুই মটর মেকানিকের কাজ শিখবি?
হীরু অবাক হয়ে বলল, আমি মোটর মেকানিকের কাজ শিখব? ইয়ার্কি করছিস? চোর-ছ্যাচাড়ের কাজ শিখব, আমি? অন্য কেউ এ কথা বললে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম। নেহায়েত তুই বলে এক্সকিউজ করে দিলাম।
হীরু কেরোসিন নিয়ে এসেছে। আশপাশে খানিকটা খুঁজেও এসেছে। টুকুও নেই। এই নিয়ে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখা গেল না। ভাত খাবার সময় অত্যন্ত সহজভাবে বলল, দুই-এক রাত বাইরে না কাটালে ছেলেপুলে শক্ত হয় না। থাকুক বাইরে। হার্ড লাইফ সম্পর্কে ধারণা হোক। মেয়ে হলে ভয়ের কথা ছিল। মেয়ে তো না।
মিনু একটি কথাও বললেন না। যথানিয়মে খাওয়া-দাওয়া করলেন। বাসন-কোসন ধুয়ে রান্নাঘরে শিকল উঠিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের কাজ রাতের মত শেষ হল। আবার ভোরবেলায় খোলা হবে। গভীর রাতে বন্ধ হবে। এই ছোট্ট ঘরটার পেছনে জীবন কেটে যাবে।
তিথির জ্বর বেশ বেড়েছে। রাতে সে কিছুই খায়নি। মিনু দু’টি আটার রুটি বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে বিরক্ত হয়ে বলেছে রুটি বানাতে তোমাকে বলেছে কে?
না খেয়ে থাকবি?
হাঁ, না খেয়ে থাকব। তুমি যাও ঘুমাও।
আমার সঙ্গে এরকম করে কথা বলছিস কেন?
ভাল করে কথা বলা ভুলে গেছি। এখন আমি শুধু বাইরের মানুষের সঙ্গে ভাল করে কথা বলতে পারি। খুব মিষ্টি করে বলি।
মিনু ঘর ছেড়ে বারান্দায় এলেন। উঠোনের পানি বেড়ে বারান্দা ছুয়েছে। এবারো কি আগের বছরের মত ঘরে পানি উঠবে? এবারো হয়ত ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে। কিন্তু যাবেনইবা কোথায়?
মিনু সারারাত বারান্দায় বসে কাটালেন। টুকুর জন্যে অপেক্ষা? হয়ত বা তাই। তবে টুকু বাড়ি না-ফেরায় তাকে খুব কাতর মনে হল না। তিনি ছেলে প্রসঙ্গে তেমন কোনো দুশ্চিন্তাও করলেন না। শুধু বসেই রইলেন। শেষ রাতে মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠল। সুন্দর জ্যোৎস্না। একা একা জ্যোৎস্না দেখতে তার ভালই লাগল।
অথচ হীরু যখন প্রথম কাউকে কিছু না বলে বাইরে রাত কাটাল কি অসম্ভব দুশ্চিন্তাই না। তিনি করেছিলেন। ঘরের একটি মানুষও ঘুমায়নি। এখন সময় পাল্টে গেছে। টুকুর বাড়ি না-ফেরায় কারো কিছু যাচ্ছে আসছে না। নিতান্তই যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। যেন সবাই ধরে নিয়েছে এরকম হবেই। আগামীকাল ভোরে যথাসময়ে সবার ঘুম ভাঙবে। দিনের কাজকর্ম শুরু হবে। আবার রাত আসবে। এর মধ্যে টুকু ফিরে এলেই ভালই, ফিরে না এলেও কিছু আসে যায় না। কে জানে হয়তবা ভালই হয়। তখন হাঁড়িতে চাল কিছু কম দিলেও চলবে।
যখন আকাশ ফরসা হল ঠিক তখন মিনু বারান্দা ছেড়ে উঠলেন। অনেক দিন পর ফজরের নামাজ পড়লেন। এ বাড়ি থেকে ধর্মকর্মও উঠে গেছে। ধর্ম সুখী মানুষের জন্যে, যাদের ইহজগতের কামনার পরও পরবর্তী জগতের জন্যে কামনা থাকে। তার এখন কোনো কামনা-বাসনা নেই। শুধু বেঁচে থাকা। তিনি রান্নাঘরে ঢুকলেন। চুলা ধরাতে খুব বেগ পেতে হল। শুকনো কাঠ নেই। এবারের বর্ষা তাকে খুব কষ্ট দেবে।
তিথির ঘুম ভেঙেছে। মুখ না ধুয়েই সে এসেছে রান্নাঘরে। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, টুকু বাড়ি ফিরেনি?
মিনু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, না। তোর জ্বর কমেছে?
তিথি বলল, তুমি এত সহজভঙ্গিতে কথা বলছি কি করে? তোমার চিন্তা লাগছে না?
আমার এত চিন্তা-টিন্তা নেই।
তাই তো দেখছি।
তোর কাছে শখানিক টাকা হবে? চাল কিনতে হবে।
ঐ দিন না কিনলে?
কিনেছি শেষ হয়েছে। আমি একা খেয়ে শেষ করিনি। বুড়ো বয়সে কি আর শুধু শুধু চাল চিবিয়ে খাওয়া যায়?
এসব কেমন ধরনের কথা, মা?
মুখ ধুয়ে আয়। চা খা। আজ কোনো নাশতা নেই। শুধু চা।
জালালুদ্দিন সাহেব যখন শুনলেন আজ শুধু চা তখন একটা হৈচৈ বাধাবার চেষ্টা করলেন। মিনু বরফশীতল গলায় বলল–কোনো রকম ঝামেলা করবে না। একবেলা নাশতা না খেলে কিছু হয় না।
জালালুদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বললেন–সকালের নাশতা হচ্ছে সারারাতের উপবাসের পর প্রথম খাওয়া। দুপুরে না খেলে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু সকালে…
চুপ।
তিনি চুপ করে গেলেন। টুকু ফিরেছে কি ফিরেনি এই ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না। দুপুরের আগে কিছু খেতে পারবেন না–এই চিন্তাটাই তাকে অস্থির করে ফেলল।
তিথি একশ টাকা দিয়েছে। এই টাকায় দুপুরের বাজার হবে।
চাল কিনতে মিনু নিজেই গেলেন। হীরুকে টাকা দিয়ে পাঠানোর কোনো মানে হয় না। ঘণ্টাখানেক পর এসে শুকনো মুখে বলবে–গ্রেট ট্র্যাজেডি। পকেট সাফা করে দিয়েছে। অল গন। দেশটা হয়ে গেছে চোরের। সবাই থিফ। গ্রেট থিফ। কিংবা দশ কেজি চাল এনে বলবে পনের কেজি। এই সংবারে বাজার অনেক দিন থেকেই মিনু করেন। এই বয়সেও পনের কেজি চালের ভারী বস্তা টেনে এনে বাকি সময়টা শরীরের ব্যথায় নড়তে পারেন না। রান্নাঘরে মাদুর পেতে শুয়ে থাকেন। দিনের বেলায় তিনি কখনো শোবার ঘরে ঘুমুতে যান না। দিনের বেলায় রান্নাঘরেই তার শোবার ঘর।