মিনু রান্না চড়িয়েছেন। আয়োজন তেমন কিছু না। গতকালের ঝড়ে একটা পেঁপে গাছ পড়ে গেছে। সেই পেঁপের একটা তরকারি। আর ডাল। চাল ক’জনের জন্যে নেয়া হবে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিথির জ্বর এসেছে, সে নিশ্চয়ই রাতে কিছু খাবে না। হীরু আসবে কি আসবে না কে জানে। গত তিন দিন ধরে রাতে খাওয়ার সময় আসছে। আজও হয়ত আসবে। টুকু এখনো ফেরেনি। তবে সে অবশ্যই ফিরবে তার যাবার জায়গা নেই। এক’দিন যখন হীরুর মত কোথাও জায়গা হবে তখন সেও আসা বন্ধ করবে।
জালালুদ্দিন রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আজ তার চোখের যন্ত্রণাটা একটু কম। আগের কবিরাজি ওষুধ বাদ দিয়ে পদ্মমধু দিচ্ছেন–এতে সম্ভবত কাজ হচ্ছে। তবে চোখ আটা আটা হয়ে থাকে–এই যা কষ্ট।
জালালুদ্দিন নিচু গলায় বললেন–এক ফোঁটা চা হবে? মিনু ঠাণ্ডা গলায় বললেন–না।
চুলা বন্ধ?
হুঁ।
বৃষ্টি-বাদলায় গলাটা খুসখুসি করে। কর একটু চা। আদা-চা।
জালালুদ্দিন খানিকটা দূরত্ব রেখে স্ত্রীর কাছে বসলেন। আজ তার চোখের যন্ত্রণা কম থাকায় মনটা বেশ ভাল। মিনুর সঙ্গে গল্পসল্প করতে ইচ্ছা করছে। প্রথম যৌবনে তাদের যখন নতুন সংসার হল–সোহাগী স্টেশনের কাছে বাসা নিয়েছিলেন। রান্নাঘর অনেক দূরে। মিনু একা রান্না করতে ভয় পেত। তখন কতই বা তার বয়স? তের কিংবা চৌদ্দ। নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে। তাকে রাতের বেলা রান্নার সময় সারাক্ষণ স্ত্রীর পাশে বসে থাকতে হত। রান্না হবার পর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একবার শোবার ঘরে আসা। কত মধুর স্মৃতি। কত বর্ষার রাত রান্নাঘরে পাশাপাশি বসে কেটেছে। অর্থহীন কত গল্প হাসি তামাশা। মান-অভিমান। আজকের এই কঠিন মিনু সেদিন কোথায় ছিল?
জালালুদ্দিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে বললেন–চোখের যন্ত্রণা একেবারেই নেই। এই যে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছি চোখ কিন্তু কড়াকড়ি করছে না।
না করলে তো ভালই।
দেখি একটু আগুন। সিগারেট খাই একটা। হীরু একটা প্যাকেট দিয়ে গেল।
মিনু দেয়াশলাই এগিয়ে দিলেন। জালালুদ্দিন সিগারেট ধরিয়ে হষ্টচিত্তে টানতে লাগলেন। নরম গলায় বললেন, পদ্মমধু আসলে খুব ভাল মেডিসিন। তবে খাঁটি জিনিস হতে হবে। দুনিয়া ভর্তি ভেজাল। পাবে কোথায় খাঁটি জিনিস?
মিনু জবাব দিলেন না। ডাল চড়িয়েছিলেন, ডালের হাঁড়ি নামিয়ে এলুমিনিয়ামের একটা মাগ চুলায় বসিয়ে দিলেন। চা হচ্ছে। জালালুদিনের চোখ চকচক করছে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন–চোখ সত্যি সেরে গেলে প্রাইভেট টিউশ্যানি ধরব। দুতিনটা ছেলেকে পড়ালেই হাজার বারশ টাকা চলে আসবে। ঢাকা শহরে প্রাইভেট টিউটরের খুবই অভাব। নাই বললেই হয়। তুমি কি বল?
মিনু কিছু বললেন না, বিচিত্র একটা ভঙ্গি করলেন। জালালুদ্দিন চোখের অসুখের কারণে সেই ভঙ্গি দেখতে পেলেন না। দেখতে পেলে তাঁর খুব মন খারাপ হত। তিনি বললেন, সংসারটা তখন ঠিকঠাক করা যাবে। তারপর হীরু একটা দোকান নেয়ার কথা বলছে, যদি সত্যি সত্যি দেয় টাকা আসবে পানির মত।
দোকান দিচ্ছে?
বলল তো। কালই বলল।
দোকানের টাকা পাচ্ছে কোথায়? বন্ধু-বান্ধব আছে। ঢাকা শহরে বুঝলে মিনু টাকা কোন সমস্যা না, তবে কায়দা-কানুন জানা থাকা চাই। ঢাকা শহরের বাতাসে পয়সা উড়ে। কেউ ধরতে পারে কেউ পারে না।
মিনু চায়ের কাপ স্বামীর দিকে এগিয়ে দিলেন। জালালুদ্দিন চায়ে চুমুক না দিয়েই বললেন, চমৎকার! তুমিও এক কাপ খাও। বৃষ্টি-বাদলার দিন ভাল লাগবে।
মিনু বিরক্ত গলায় বললেন–তোমার খাওয়া তুমি খাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তিনি তিথির জন্যে লেবুর শরবত নিয়ে শোবার ঘরে গেলেন। ঘর নিকষ অন্ধকার। এই অন্ধকারে তিথি এখনো ঠিক আগের মতই বসে আছে।
লেবুর শরবত এনেছি–নে।
তিথি বলল, কিছু খাব না, খেতে ইচ্ছে করছে না। টুকু এসেছে?
না।
বৃষ্টির মধ্যে ভিজছে বোধ হয়। আবার একটা বড় অসুখ বাঁধাবে।
মিনু তীব্র গলায় বললেন, আজ আসুক আমি হারামজাদার বিষ ঝাড়ব। তিথি শীতল গলায় বলল, বিষ ঝেড়ে ঝেড়ে তো হীরুর এই অবস্থা করেছ। আর না হয় নাই ঝাড়লে।
মিনু তিথিকে একটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও বললেন না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন।
উঠোনে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। মিনু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, টুকু এসেছে বোধ হয়। টুকু না হীরু এসেছে। সে তার মায়ের মুখের উপর টর্চ ফেলে বলল, চারদিক এমন ডার্ক করে রেখেছ ব্যাপার কি?
তিনি জবাব দিলেন না। হীরু মাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, বাতি টাতি জ্বালাও। কারো কোনো সাড়াশব্দও পাচ্ছি না। সব ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? রাত তো বেশি হয়নি। আপা বাসায় আছে?
সে এই কথারও জবাব পেল না। এ বাড়িতে তার অবস্থাও তার বাবার মত। বেশির ভাগ কথারই কেউ কোনো জবাব দেয় না। জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করে না।
হীরু অন্ধকারেই গোসল সেরে ফেলল। কেরোসিনের অভাবে বাতি জ্বলছে না জেনেও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে অতি উৎসাহে তিথিকে বলতে শুরু করল কি করে সে আজ ব্রান্ড নিউ একটা ছাতা জোগাড় করে ফেলেছে।
বুঝলি তিথি, বাস থেকে নামার সময় হঠাৎ দেখি আমার পায়ের কাছে একটা ছাতা। আমার পাশে এক গর্দভ নাম্বার ওয়ান বসে ছিল। ছাতা না নিয়েই ঐ শালা বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়েছে।
তুই ঐ ছাতা নিয়ে চলে এলি?
হ্যাঁ। আমি না নিলে অন্য কেউ নিত। কি, নিত না? ব্রান্ড নিউ জিনিস। লেবেলটা পর্যন্ত আছে।