তুই কী বলছিস আমি যাব না?
তা বলছি না। এখানে থেকেই বা তুমি কী করবে। শুধু বলছি যে, সাবধানে থাকবে।
নিতান্ত কাকতালীয় একটা ব্যাপার ঘটল অরুর হলুয়াঘাট রওনা হবার ঠিক আগের দিন–একটি রেজিস্ট্রি চিঠি এসে উপস্থিত। প্রাপক শাহানা বেগম। প্রেরক আব্দুল মতিন। খাম খুলে দেখা গেল বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র। ধুপচাঁচা গ্রামের মৌলানা আবু বকর সাহেবের তৃতীয় কন্যা মোসাম্মত নূরুর নাহার বেগম (লাইলীর) সহিত কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জনাব আব্দুল কুদ্দুস। সাহেবের প্রথম পুত্র আব্দুল মতিনের শুভ বিবাহ। বিবাহ অনুষ্ঠানে সবান্ধব উপস্থিত থাকার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। অরুকে আহত করবার জন্যেই চিঠি পাঠানো। তবে অরু, আহত হল কি-না বোঝা গেল না। তার চেহারায় মনের অবস্থার কোনো ছাপ পড়ল না।
অরু, হালুয়াঘাট পৌঁছে কোনো খবর দিল না। তিথি পরপর দু’টি চিঠি লিখল–সেই চিঠিরও জবাব এল না। এক মাসের মাথায় টুকু চিন্তিত হয়ে ধানমণ্ডির বাসায় খোঁজ নিতে গেল। ড. গোরিং অফিসেই ছিলেন। তিনি সব শুনে চিন্তিত মুখে বললেন চিঠির জবাব দিচ্ছেন না কেন তা তো বুঝতে পারছি না। তার সঙ্গে গত সপ্তাহেই দেখা হয়েছে। সে বেশ ভাল আছে–এইটুকু বলতে পারি।
চিঠি কী হাতে পৌঁছোচ্ছে না?
না পৌঁছানোর কোনো কারণ নেই। তাছাড়া তোমাদের চিঠি না পেলেও তো সে তার খোঁজ দেবে। দেবে না?
আমার কী মনে হয় জানো–সে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে চেষ্টা করছে। পরিচিত জগৎ থেকে লুকিয়ে পড়তে চাইছে। তোমাদের বাংলাদেশী মেয়েরা সামাজিক অমর্যাদার ব্যাপারে খুব সেনসেটিভ। তুমি বরং প্রিপেড টেলিগ্রাম করে দাও। তারপরে যদি জবাব না। আসে নিজেই চলে যাও। হালুয়াঘাট এমন কিছু দূরের জায়গা নয়।
প্রিপেড টেলিগ্রামের জবাব এল। অরু জানিয়েছে–সে ভাল আছে। তার কিছুদিন পর টুকুর কাছে দুই লাইনের চিঠি এল।
টুকু,
আমি ভাল আছি। কাজ শুরু করেছি। আমাকে নিয়ে শুধু শুধু কেউ যেন দুশ্চিন্তা না করে।
ইতি— অরু আপা।
অরুর সঙ্গে তার পরিবারের এই হচ্ছে শেষ যোগাযোগ। এই পরিবারের সদস্যরা অরুর আর কোনো খোঁজ পায়নি। টুকু এবং গ্রিন বয়েজ ক্লাবের সেক্রেটারি বজলুর রহমান খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করল। তেমন কিছু জানা গেল না। এই এনজিও কাজকর্ম গুটিয়ে স্বদেশে চলে গেছে। এখানকার কেউ তেমন কিছু বলতে পারে না। ড. গোরিং একজন বাঙালি মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন–এইটুকু জানা গেল। তবে সেই একজন অরু কী-না তা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারল না। নিউইয়র্ক এনজিওর হেড অফিসে যোগাযোগ করেও কিছু জানা গেল না। হেড অফিস জানাল ড. গোরিং এখন আর তাদের সঙ্গে কর্মরত নয়। কাজেই তারা তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলতে পারছে না।
শুধু হীরুর পীর সাহেব হীরুর কান্নাকাটিতে গলে গিয়ে জ্বীনের মারফত খবর এনে দিলেন–অরু ভালই আছে। তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। মাতা ও কন্যা সুখেই আছে। পীর সাহেবের কোনো কথাই হীরু অবিশ্বাস করে না। এইটা করল। ক্ষীণ স্বরে বলল, কী বললেন স্যার? কন্যাসন্তান হয়েছে?
হ্যাঁ বাবা হয়েছে। জ্বীনের মারফত খবর পেয়েছি।
জ্বীন কোনো ভুল করেনি তো? মানে মিসটেক। মানুষ যেমন ভুল করতে পারে জ্বীনও নিশ্চয়ই পারে।
তুমি এখন যাও হীরু।
অন্য একটা জ্বীনকে দিয়ে যদি স্যার একটু ট্রাই করেন মানে আমরা খুব কষ্টে আছি।
তুমি বিদেয় হও তো। হীরু মুখ কালো করে চলে এল। এই প্রথম পীরের আস্তানা থেকে বের হয়ে সে মনে মনে বলল—শালা ফটকাবাজ।
তিথি অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে
তিথি অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে। হাঁটতে তার ভাল লাগছে। আকাশ ঘন নীল। ঝলমল করছে। রোদে শিশুদের গায়ের ওম। এমন সময় হঁটিতে ভাল লাগারই কথা। তিথির কোনো গন্তব্য নেই। একটা ফুলওয়ালীর কাছ থেকে সে ফুল কিনল। একজন ভদ্রলোক তার কাছে জানতে চাইলেন, দিলু রোড কোন দিকে? সে ভদ্রলোককে খুব ভাল করে দিলু রোডে যাবার পথ বলে দিল। ভদ্রলোক কৃতজ্ঞচোখে চলে যাচ্ছেন। সে হাঁটছে। বড় ভাল লাগছে হাঁটতে।
একেকটা দিন এ রকম হয়। হাঁটতে ভাল লাগে। বিশেষ করে যখন গন্তব্য বলে কিছু থাকে না। যাবার কোনো বিশেষ জায়গা না থাকার মানেই হচ্ছে সব জায়গায় যাওয়া যায়।
তিথি বিকেলের দিকে নিতান্ত ক্লান্ত ও বিরক্ত হবার পরই নাসিমুদ্দিনকে দেখতে গেল। সে অনেক’দিন ধরে হাসপাতালে পড়ে আছে। তাকে দেখতে যাওয়া হয় না। বিশেষ কোথাও যেতে তিথির ইচ্ছা করে না। নাসিমুদ্দিন যদি রাস্তায় থাকত বেশ হত। অনেকবার দেখা হত।
নাসিম বত্ৰিশ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় পড়ে আছে। তিথিকে দেখে উজ্জ্বল চোখে তাকাল, এস তিথি এস। একমাত্র তুমিই আসি। আর কেউ আসে না। আমার স্ত্রীও আসে না।
আপনি কেমন আছেন?
ভাল না। পায়ে কী যেন হয়েছে, কেউ কিছু বলে ও না। পা না-কি কেটে বাদ দিতে হবে। পাপে ধরেছে, বুঝলে তিথি পাপ। এই জীবনটা মহাপাপ করতে করতে কাটালাম।
খুব ব্যথা হয়?
আমার কথা বাদ দাও। তুমি কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমার ভাইয়ের ব্যবসা না-কি ভাল হচ্ছে?
হ্যাঁ।
তোমাকে সহ্য করে তো। একবার টাকা-পয়সার মুখ দেখলে পুরোনো কথা কেউ মনে রাখে। না। তোমার ভাই কী তোমাকে হাতখরচ দেয়?
দেয়।
ভাল। খুব ভাল। শুনে খুশি হলাম। তোমার মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন তিথি? কিছু খাবে? একটা কলা খাও। এরা হাসপাতাল থেকে কলা ডিম এইসব দেয়, খেতে পারি না। তুমি কলাটা খাও।