তিথি।
জি।
থাকতে চাইলে থাক, অসুবিধা কিছু নেই। খালি ঘর আছে।
না থাকব না।
পরশু, তরশু একবার এসো। দেখি যদি এর মধ্যে ভাল কোনো পার্টি পাই। ফরেনার পাওয়া গেলে ভাল। এদের দরাজ দিল। খুশি হলে হুঁশ থাকে না। তবে সব না। কিছু আছে বিরাট খচ্চর। চামড়া সাদা হলেই যে দরাজ দিল হয় এটা ঠিক না। সাদা চামড়ার মধ্যেই খচ্চর বেশি।
নাসিম নিজের ছাতা হাতে তিথিকে বাসে তুলে দিতে গেল। যাবে জানা কথা। যে অল্প কিছু ভাল মানুষের সংস্পর্শে তিথি এসেছে নাসিম তার মধ্য একজন। সে বাসে তিথিকে শুধু সে উঠিয়েই দিয়ে আসবে তাই না বাসের ড্রাইভারকে বলে আসবে একটু খেয়াল রাখবেন ভাইসব, একা যাচ্ছে।
বৃষ্টি ধরে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি উঠে গেছে। পানি ভেঙে যেতে হচ্ছে। নাসিম বলল, এক ফোঁটা বৃষ্টি হলে দুই হাত পানি হয়ে যায়। এই রহস্যটা কি বুঝলাম না। তিথি কিছু বলল না। নাসিম বলল, তোমার ভাই চাকরি-বাকরি কিছু পেয়েছে?
না।
মটর মেকানিকের কাজ শিখবে নাকি জিজ্ঞেস করো তো। লাগিয়ে দেব। ভালমত কাজ শিখতে পারলে কাঁচা পয়সা আছে, জিজ্ঞেস করো।
আচ্ছা জিজ্ঞেস করব।
টেলিফোন করতে চেয়েছিলে–কার কাছে টেলিফোন?
চেনা একজন।
পাওয়ারফুল কেউ হলে যোগাযোগ রাখবে কখন দরকার হয় কিছু বলা যায় না।
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছানো মাত্র বাস পাওয়া গেল। ফাঁকা বাস। পেছনের দিকে তিন-চারজন মানুষ বসে আছে। নাসিম বাসের ড্রাইভারকে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ভাইজান একটু দেখেশুনে নামাবেন, মেয়েছেলে একা যাচ্ছে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা এগিয়ে দিল। নাসিম সিগারেট খায় না, অন্যকে দেবার জন্যে সব সময় সঙ্গে রাখে।
তিথির হাতে সে একশ টাকার নোটি গুঁজে দিল। এটা হচ্ছে ধার। হাতে টাকা এলে শোধ দিতে হবে।
বাস না ছাড়া পর্যন্ত নাসিম ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল। তিথি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই মানুষটা তার চমৎকার একজন বড় ভাই হতে পারত। কেন হল না?
হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে
হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে মিনু দেখলেন তেল নেই। অথচ কাল হারিকেনে তেল ভরার পরও বোতলে চার আঙুলের মত অবশিষ্ট ছিল। গেল কোথায়? টুকু ফেলে দিয়েছে? সকালবেলা কেরোসিনের বোতল নিয়ে কি যেন করছিল; মিনুর বিরক্তির সীমা রইল না। টুকু বাড়ি নেই। সকালে টুকুকে তিনি কিছু শাস্তি দিয়েছেন। দুবার চুল ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিযেছেন। সে নিঃশব্দে কেঁদেছে কিন্তু কিছু বলেনি। তিনি একাই চেঁচিয়েছেন কঠিন কঠিন বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন। টুকু শুধু শুনে গেছে, মাঝে মাঝে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়েছেন যাতে মনে হয় পৃথিবীর হৃদয়হীনতায় সে খুব অবাক হচ্ছে। এতে মিনুর রাগ আরও বেড়েছে। সেই রাতের চরমতম প্রকাশ তিনি দেখালেন। দুপুরে ভাত খাবার সময়। টুকুর সামনে থেকে ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে কর্কশ গলায় বললেন, যা তোরা ভাত নেই।
টুকু মায়ের দিকে কয়েকবার ভয়ে ভয়ে তাকাল। উঠে গেল না। বসেই রইল। সে ক্ষিধে সহ্য করতে পারে না। মিনু কঠিন গলায় বললেন উঠ, নয় তো পিঠে চ্যালাকাঠি ভাঙব। টুকু তবু বসে রইল। তিনি সত্যি সত্যি হাতে চ্যালাকাঠ নিলেন। টুকু উঠে বারান্দার জলচৌকিতে বসে রইল। তার মনে ক্ষীণ আশা কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়ার ডাক আসবে। বিশেষ করে আপা আজ বাসায় আছে। সে নিশ্চয়ই তাকে ফেলে খাবে না। টুকু অবাক হয়ে দেখল। আপা তাকে রেখেই ভাত খেল। খাওয়ার শেষে বারান্দায় হাত ধুতে এসে বলল, টুকু আমাকে মোড়ের দোকান থেকে একটা পান এনে দে। বমি বমি লাগছে।
টুকু পান এনে দিয়ে আবার এসে বসল। বারান্দায়। অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল, মা রান্নাঘরের ঝামেলা শেষ করে দরজায় শিকল তুলে দিচ্ছেন। এই বাড়ির একজন যে না খেয়ে আছে, এই কথা তিনি বোধ হয় সত্যি ভুলে গেছেন। টুকু তবুও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ভয়ে ভয়ে শোবার ঘরে উঁকি দিল–মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। হয়ত ঘুমিয়েই পড়েছেন। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
টুকু ভীতু ধরনের ছেলে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই ফিরে। আজ এখনো ফিরছে না। দিন খারাপ করেছে। আজও হয়ত ঝড়বৃষ্টি হবে। ক’দিন ধরে রোজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছে। মিনু তেলশূন্য হারিকেন নিয়ে তিথির ঘরে এলেন।
তিথি চাদর গায়ে বিছনায় বসে আছে। তার গায়ে জ্বর। ঐদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকেই সে জ্বরে পড়েছে। এখন জ্বর খানিকটা বেড়েছে। খোলা জানালা দিয়ে যে বাতাস আসছে তা তেমন ঠাণ্ডা নয়। তবু তিথির গা শিরশির করছে। উঠে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে না।
মিনু ঘরে ঢুকেই বলল–চার আঙুল তেল ছিল বোতলে। কোথায় গেল জানিস? তিথি বলল, জানি না।
বাতাসে তো উড়ে যায়নি।
বিড়াল ফেলে দিয়েছে হয়ত।
এখন কাকে দিয়ে তেল আনাই?
টুকু আসেনি এখনো?
না।
ও এলে এনে দিবে। তুমি জানালা বন্ধ করে দাও তো মা, ঠাণ্ডা লাগছে।
এই গরমে ঠাণ্ডা লাগছে? জ্বর নাকি? দেখি।
মিনু, তিথির কপালে ছুঁয়ে দেখতে গেলেন। তিথি একটু সরে গিয়ে বলল, গায়ে হাত দিও না মা। মিনু বিস্মিত হয়ে বললেন–গায়ে হাত দিলে কি?
কিছু না। আমার ভাল লাগে না।
মা গায়ে হাত দিলে ভাল লাগে না, এটা কি ধরনের কথা? বলছিস কি এসব?
তোমার সঙ্গে বকবক করতেও ইচ্ছা করছে না। জানালাটা বন্ধ করে চলে যাও।
মিনু জানালা বন্ধ করে চলে গেলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝমোঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। সমস্ত বাড়ি অন্ধকার। রান্নাঘরে চুলায় আগুন জ্বলছে। বাড়িতে এইটুকুই আলো।