হীরুর সময় এত ব্যস্ততায় কাটছে যে এ্যানার সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করারও সময় পাচ্ছে না। অফিস-আদালত ছুটির দিনে বন্ধ থাকে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট ছুটির দিনে সকাল সকাল খুলতে হয়, বন্ধ করতে হয় গভীর রাতে। অবশ্যি রাত যতই হোক এ্যানা তার জন্য অপেক্ষা করে। কড়কড়া ঠাণ্ডা ভাত খেতে হয় না। হীরু বাসায় পা দেয়ামাত্র এ্যানা সব কিছু গরম করতে বসে। একজন তার জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করছে এটা ভাবতেও ভাল লাগে।
রাতে পাশাপাশি ঘুমুতে গিয়ে হীরুর প্রায়ই মনে হয় সবটাই বোধ হয় কল্পনা। তার মত একটা ছেলেকে এ্যানা বিয়ে করবে। কেন? এ্যানা নিশ্চয়ই অন্য কাউকে বিয়ে করে মহাসুখে আছে। তার পাশে যে শুয়ে আছে সে ধরা-ছোঁয়ার কেউ না। কল্পনার একজন মানুষ। হীরু খুব দীর্ঘ একটা স্বপ্ন দেখে চলছে। এক’দিন স্বপ্ন কেটে যাবে। সে দেখবে তার পাশে কেউ নেই। পকেটে দু’টা ডেম্প সিগারেট, একটা দেয়াশলাইয়ের ব্যাক্স এবং ন্যাতন্যাতে মযলা কয়েকটা নোট নিয়ে সে রাস্তায় হাঁটছে। ঘুমুতে যাবার আগে হীরুর খুব ইচ্ছা করে এ্যানার সঙ্গে আবেগ এবং ভালবাসার কিছু কথা বলতে। রেস্টটুরেন্টের কথা না, সংসারের কথা না, অন্য রকম কিছু কথা। যা বলতে হয় অস্বাভাবিক নরম গলায়। যা বলার সময় গলার স্বর কেঁপে যায়, বুকের গভীরে সুখের মত কিছু ব্যথা বোধহয়। হীরু এসব কথা কখনো বলতে পারে না। বলতে গেলেই এ্যানা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, চুপ কর তো। এই সব কথা কোথেকে শিখলে। ছিঃ! হীরু আহত হয়ে বলে–ছিঃর কী আছে?
ঘুমাও। সিনেমা সিনেমা কথা আমার অসহ্য লাগে।
হীরুর চোখে পানি আসার উপক্রম হয়। চোখের পানি আটকাতে তার খুব বেগ পেতে হয়। এ্যান্য এই ফাকে সংসারের কথা নিয়ে আসে। এইসব কথা শুনতে হীরুর একেবারে ভাল লাগে না। তবু সে মন দিয়ে শোনে। এ্যানার সঙ্গে কথা বলারও আলাদা আনন্দ আছে। এই মেয়েটি একান্তই তার অন্য কারোর নয়। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে তারা দু’জন কথা বলছে এও তো এক পরম বিস্ময়। তার মতো কজন মানুষের এই সৌভাগ্য হয়? হীরু ভয়ে ভয়ে এ্যানার গায়ে হাত রাখে। সারাক্ষণই তার মনে হয় এই বুঝি এ্যানা তার হাত সরিয়ে দিল। এ্যানা হাত সরায় না। এও কী কম আনন্দের ব্যাপার? এ্যানা ঘুম ঘুম গলায় বলে, তিথি আপা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বল তো?
জানি না।
কারো সঙ্গে কথাও বলে না। চুপচাপ থাকে।
একেক জনের একেক স্বভাব।
তিথি আপাকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা শুনি–এসব কী সত্যি?
না।
টুকু যে কিছু করে না, পড়াশোনা না কিছু না রাতদিন ঘোবাফিরা। তোমরা কিছু বল না কেন?
বললে শুনে না।
বলে দেখেছ কখনো?
হীরুর ঘুম পায়। সে কোনো উত্তর দেয় না। এ্যানা শান্তভঙ্গিতে বলে, তুমি হচ্ছে সংসারের বড়। তোমাকেই তো সব দেখতে হবে।
দেখাদেখি করে কিছু হয় না। সব ভাগ্য।
আমার কলেজে ভর্তির ব্যাপারেও তো তুমি কিছু বলছ না।
হীরুর ঘুম কেটে যায়। সে শংকিতে গলায় বলে, তুমি কলেজে পড়বে না-কী?
পড়ব না–পড়ব না কেন?
মেয়েছেলের পড়াশোনার কোনো দরকার নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট আর পয়সা নষ্ট।
এইসব বাজে কথা তোমাকে কে শিখিয়েছে?
শেখানোর কী আছে? সবাই তো জানে।
আজেবাজে কথা আর আমার সামনে বলবে না।
আচ্ছা।
গা থেকে হাত সরাও। হাত সরিয়ে ঘুমাও।
একবার ঘুম কেটে গেলে হীরুর আর সহজে ঘুম আসতে চায় না। সে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। এ বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত আরো অনেকেই জাগে। জাগেন মিনু, প্রায় রাতেই তাঁর এক ফোঁটা ঘুম আসে না। জাগে তিথি ও অরু। দু’জন এক খাটে ঘুময়। দু’জনই জানে অন্যজন জেগে৷ আছে তবু একজন অন্যজনকে তা জানায় না। শুধু নিশ্চিন্ত মনে ঘুমান জালালুদ্দিন। আজকাল রাতে তার ভাল ঘুম হয়। এক ঘুমে রাত শেষ করে দেন। ঘুমের মধ্যে নানান রকম স্বপ্ন দেখেন। চোখে দেখতে পান না বলেই বোধ হয় রাতের স্বপ্নগুলির জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করে থাকেন। তার কাছে স্বপ্নের মানুষগুলিকে বাস্তবের মানুষদের চাইতেও অনেক বেশি সুন্দর মনে হয়।
অরুর চাকরি হয়ে গেল
জুন মাসের মাঝামাঝি অরুর চাকরি হয়ে গেল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে পোস্টিং। একটি বিদেশী এনজিওর আস্থায়ী চাকরি। চাকরির মেয়াদ তিন থেকে চার মাস। একুশ’শ টাকা বেতন। খাওয়াথাকা ফ্রি। হালুয়াঘাটে গারো ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কুল করা হয়েছে। সেই স্কুলে টিচার। অংক, বাংলা, ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ সেলাই এসব শেখাতে হবে।
টুকু বলল, আপা আজ দিনের মধ্যে ওদের জানাতে হবে তুমি যাবে কী যাবে না। যদি যাও তাহলে আজই ঢাকার হেড অফিসে জয়েন করবে। আজ থেকেই তোমার বেতন শুরু হবে। তুমি যাবে?
বুঝতে পারছি না।
টুকু বিরক্ত হয়ে বলল, সবই তো বুঝিয়ে বললাম, আর কী বুঝতে পারছি না?
চাকরি করতে পারব কী পারব না।–এইটাই বুঝছি না। আমাকে দিয়ে কী এইসব হবে?
অন্য মেয়েরা কিভাবে করে?
আমি কী অন্য মেয়েদের মত?
কেন, তুমি আলাদা কীভাবে?
তুই বুঝতে পারছিস না। বাসা থেকে ওরা ছাড়বে কেন? এত দূরে চাকরি, ঢাকায় হলেও একটা কথা ছিল।
তুমি তাহলে চাকরি নেবে না?
নেব না তো বলিনি, ভাবছি।
যা ভাবাভাবির ঘণ্টাখানিকের মধ্যে ভেবে নাও। বাসার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। বাসার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক।
টেম্পোরারি চাকরি। চার মাস পর ছাড়িয়ে দেবে।