টুকু অরুকে নিয়ে বের হয়েছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বলছে না। কযেকবার জিজ্ঞেস করেও অরু কোনো জবাব পায়নি। টুকু শুধু বলেছে চল না। যাই।
অরু সুতির একটা শাড়ি পরেছে। সাধারণ শাড়ি, কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে এই সাধারণ শাড়িটি তাকে খুব মানিয়ে গেছে। তাকে দেখাচ্ছে কিশোরী একটি মেয়ের মতো। যে মেয়ের চোখে পৃথিবী তার রহস্য ও আনন্দের জানালা একটি একটি করে খুলতে শুরু করেছে।
টুকু বলল, এইখানে একটু দাঁড়াও আপা। একতলা সাদা রঙের একটা দালানের সামনে অরু দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনের জায়গাটা ফুলের গাছে ভর্তি। নিকেলের চশমা পরা বৃদ্ধ একজন ভদ্রলোক বাগানে কাজ করছেন। আরু বলল, এটা কার বাড়ি?
ওসমান সাহেবের বাড়ি।
এই বাড়িতে কী?
আছে একটা ব্যাপার। তুমি দাঁড়াও। আমি উনার সঙ্গে কথা বলে আসি।
ব্যাপারটা কী তুই আমাকে বলবি না?
একটা চাকরির ব্যাপার। তোমার একটা চাকরি হয়। কী-না দেখি।
তুই আমার চাকরি জোগাড় করে দিবি?
না, আমি দেব কিভাবে? বজলু ভাই চেষ্টা-চরিত্র করছেন।
বজলু ভাইটা কে?
তুমি চিনবে না, গ্রিন বয়েজ ক্লাবের সেক্রেটারি। বজলু ভাইয়ের এখানে থাকার কথা। দাঁড়াও, আমি খোঁজ নিয়ে আসি। বজলু ভাই এসে চলে গেলেন। কী-না কে জানে।
অরু দাঁড়িয়ে রইল। সুন্দর একটা বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার এক ধরনের লজ্জা আছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার মানে এই সুন্দর বাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি তার নেই। সে বাইরের একজন। অরু দেখল। বুড়ো ভদ্রলোক নিজের মনে কাজ করছেন। টুকু হাত কচলে কচলে কী-সব বলছে। টুকুর ভঙ্গি বিনীত প্রার্থনার ভঙ্গি। অভাব দুঃখ-দুৰ্দশার কথা বলছে বোধ হয়। অরুর খুব লজ্জা লাগছে। কী আশ্চর্য, ভদ্রলোক একবার মুখ তুলে তাকাচ্ছেনও না। কী হয় একবার তাকালে? একটা মানুষ নিশ্চয়ই বাগানের গাছগুলির চেয়েও তুচ্ছ না।
টুকু ফিরে এল। তার মুখ লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেছে। ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলছে। কী কথা হয়েছে কে জানে। অরু বলল, চল যাই। টুকু বলল, আচ্ছা চল শুধু শুধু আসলাম।
অরু বলল, তোকে অপমান করেনি তো?
আরে না। অপমান করবে। কী। খুব যারা বড় মানুষ তারা কাউকে অপমান করে না। তারা খুব মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে। অভাবী মানুষদের কথা শুনলে আবেগে আপুত হয়ে যায়। তখনি আমার রাগ লাগে। অসম্ভব রাগ লাগে।
তোকে দেখে কিন্তু মনে হয় না তোর শরীরে রাগ আছে। তোর চেহারাটা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।
টুকু হঠাৎ গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেলে বলল, তুমি কোনো রকম চিন্তা করবে না আপা, বজলু ভাই একটা ব্যবস্থা করবেই। খুব ছোটাছুটি করছে।
তোর বজলু ভাইয়ের হাতে বুঝি অনেক চাকরি?
না। বজলু ভাই আমাদের মতই গরিব মানুষ। তবে অন্য গরিবের জন্যে খুব ছোটাছুটি করতে পারে।
কেন ছোটাছুটি করে?
জানি না। ছোটাছুটি করতে বোধ হয়। ভাল লাগে।
একটা রিকশা নে টুকু, আর হাঁটতে পারছি না। আমার কাছে টাকা আছে।
টুকু রিকশা নিল; অরু বলল, ফেরার পথে হীরুর রেস্টুরেন্ট দেখে যাই চল।
টুকুর রেস্টুরেন্টে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। সে ক’দিন ধরেই হীরুকে এড়িয়ে চলছে। কারণ হীরু চায় টুকু ক্যাশে এসে বসুক। হীরু হচ্ছে দোকানের মালিক তাকে তো সারাক্ষণ ক্যাশ বাক্স নিয়ে বসে থাকলে চলে না। ক্যাশে বসবে টুকু। সে হবে ম্যানেজার। রেস্টুরেন্টর ম্যানেজার। খুব সহজ ব্যাপার তো না। এই বাজারে ম্যানেজারি পাওয়া আর বাঘের দুধ পাওয়া এক কথা। টুকু রাজি হয় না। তার ভাল লাগে পথে পথে ঘুরতে!
হীরু ক্যাশে বসে ছিল। টুকুদের নামতে দেখে অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেল। এই প্রথম নিজের লোক রেস্টুরেন্ট দেখতে আসছে। এ্যানা বা তিথি এখনো আসেনি। বাসায় কারো মনে হচ্ছে কোনো আগ্রহ নেই। যাক তবু দু’জন এল।
অরু বলল, হীরু তোর কাজকর্ম দেখতে এলাম। বাহ সুন্দর তো। হীরুর মনটা ভাল হয়ে গেল। চারদিকে সবুজ কাগজ সেঁটে দোকানটাকে সে মন্দ সাজায়নি? টেবিলে ধবধবে সাদা ওয়াল ক্লথ। তিন দিকের দেয়ালে ক্যালেন্ডার থেকে সুন্দর সুন্দর ছবি কেটে বসানো হয়েছে। তার সীমিত সাধ্যে যতটুকু সম্ভব সে করেছে। হীরু বলল, গরিব মানুষের রেস্টুরেন্ট আপা। দেখার কিছু নেই। কেবিনে চলে যাও। কেবিনে বসে চা খাও। এই এক নম্বর কেবিনে দু’টা চা দে। কাপ গরম পানি দিয়ে ধুয়ে আনবি।
কেবিনও আছে না-কী?
থাকবে না! কী বল তুমি! মেয়েছেলের জন্যে দু’টা কেবিন। এক নম্বর কেবিন আর দুনম্বর কেবিন।
চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না?
পরোটা-ভাজি আর ডাল আছে। আগামী সপ্তাহ থেকে দুপুরে তেহারি হবে। ফুল প্লেট দশ, হাফ প্লেট ছ’টাকা। তেহারির সঙ্গে সালাদ ফ্রি।
অরু এবং টুকু চা খেল। কেবিন অরুর খুব পছন্দ হল। পর্দা টেনে দিলেই নিজদের ছোট্ট আলাদা একটা জগৎ। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল। তার যদি সত্যি কোনোদিন চাকরি-টাকরি হয় তাহলে সে প্রায়ই কোনো বন্ধু-বান্ধব জোগাড় করে এই রেস্টটুরেন্টের কেবিনে বসে চা খেতে খেতে গল্প করবে। সুখ-দুঃখের একান্ত কিছু গল্প।
অরুরা চলে যাবার সময় হীরু বলল, চায়ের দাম দিয়ে যাও আপা। ফ্রির কোনো কারবারই নেই। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবার নগদ পয়সা দিতে হবে। রাগ কর বা না করি–এটা হল ব্যবসা।
অরু বলল, কত দিতে হবে রে? দু’টাকা। অরু, হাসিমুখে দু’টাকা বের করল।