এ্যানা সহজ স্বরে বলল, আমি বদ মেয়ে না। আপনার ছেলেটা বদ। আপনার ছেলের ভাগ্য ভাল যে আমি তাকে বিয়ে করেছি।
মেয়েটির গালে প্রচণ্ড একটা বড় চড় কষিয়ে দেবার ইচ্ছা মিনু অনেক কষ্টে দমন করলেন। নতুন বউয়ের গায়ে এত তাড়াতাড়ি হাত তোলা ঠিক হবে না। তাছাড়া ছেলের বউকে শায়েস্তা করতে হয় ছেলেকে দিয়ে। তিনিও তাই করবেন।
জালালুদ্দিন এ্যানাকে বেশ পছন্দ করলেন। তেজী মেয়ে। এই সংসারের জন্যে এ রকম তেজী মেয়েই দরকার। মেয়েটির সঙ্গে খাতির রাখলে ভবিষ্যতে সুবিধা হবে–এই ধারণা নিয়ে তিনি ভাব জমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। মধুর স্বরে যখন-তখন ডাকেন–মা এ্যানা, একটু শুনে যাও তো। এ্যানা সঙ্গে সঙ্গে এসে পুরুষালী গলায় বলে, কী জন্যে ডাকছেন?
এমনি ডাকাছি মা। এমনি। গল্প করি।
কী গল্প করবেন?
সুখ-দুঃখের গল্প।
গল্প শুনতে আমার ভাল লাগে না। চা খেতে চাইলে বলুন চা এনে দিচ্ছি।
আচ্ছা দাও, তাই দাও। চোখ দু’টা যাওয়ায় একেবারে অচল হয়ে পড়েছি। চিকিৎসাও হচ্ছে না।
চিকিৎসা হচ্ছে না কেন?
কে করাবে চিকিৎসা?
কেন–আপনার ছেলে করাবে।
আমার ছেলে আমার চিকিৎসা করাবে?
আপনার ছেলে আপনার চিকিৎসা করাবে না তো বাইরের মানুষে চিকিৎসা করাবে? এই সংসারের মানুষ তুমি চিন না মা। এই সংসারের মানুষগুলি কেমন তোমাকে বলি…
জালালুদ্দিন বিমলানন্দ ভোগ করছেন। সংসারের মানুষ চিনিয়ে দেবার দায়িত্ব খুব সহজ দায়িত্ব নয়। মনোযোগী শ্রোতার সঙ্গে দার্শনিক কথাবার্তা বলতে তার ভাল লাগে। এই মেয়েটার মনোযোগী শ্রোতা হবার সম্ভাবনা আছে।
সংসারে মানুষ থাকে তিন রকমের–অগ্নি-মানুষ, মাটি-মানুষ আর জল-মানুষ। অমানুষও থাকে তিন পদের… জালালুদিনের হঠাৎ সন্দেহ হল সামনে কেউ নেই। মানুষ কয় প্রকার ও কী কী এই প্রসঙ্গ বন্ধ রেখে মৃদু স্বরে ডাকলেন–মা কোথায় গো? মা কোথায়? মার জবাব পাওয়া গেল না। মা চা বানাতে গেছে। শ্বশুরের দার্শনিক কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই।
বাবা চা নিন।
জালালুদ্দিন গম্ভীর মুখে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলেন। চায়ে চুমুক দিলেন–চমৎকার চা, কিন্তু তার গভীর মুখভঙ্গির বদল হল না। এ্যানাকে তিনি বুঝতে পারছেন না। কাউকে বুঝতে না পারলে অস্বস্তি লেগে থাকে। কে জানে এই মেয়েটা ঘর ভাঙনি মেয়ে কি-না। ঘর যদি ভেঙে দেয় তাহলে তিনি যাবেন কোথায়? তাঁর এই বয়সে, শরীরের এই অবস্থায় একটি শক্ত আশ্রয় প্রয়োজন। চা তার বিস্বাদ মনে হল।
হীরুর ইচ্ছা ছিল তার চায়ের দোকানের প্রথম চা খাওয়াবে পীর সাহেবকে। তাকে হাতেপায়ে ধরে নিয়ে আসবে। এতে দোকানের একটা পারলিসিটিও হবে। এত বড় পীর এসে চা খেয়ে গিয়েছে কম কথা না। পীর সাহেব আসতে রাজি হলেন না। তবে চায়ের বিশাল কেতলিতে ফুঁ দিয়ে দিলেন। বললেন, এতেই কাজ হবে। হীরু বিশেষ ভরসা পেল না।
জুন মাসের তিন তারিখ ভোর ছ’টায় তার চায়ের দোকান চালু হল। চা, পরোটা, সবজি ভাজি এবং ডাল এই তিন আইটেম। পরোটা, ভাজি এবং ডালের জন্য একজন কারিগর রাখা হল। কারিগরের নাম–মজনু মিয়া। কারিগরের দেশ ফরিদপুর। বয়স পঞ্চাশ। ছোটখাটো মানুষ, কথা বলে ফিসফিস করে এবং সেই সব কথার বেশির ভাগই বোঝা যায় না। কারিগরের বা হাতটা আচল। সেই অচল হাত শুকিয়ে দড়ির মত হয়ে আছে। শরীরের অনাবশ্যক অঙ্গ হিসেবে হাতটা কাঁধের সঙ্গে ঝুলতে থাকে। একটি সচল হাত কারিগর মজনু মিয়ার জন্যে যথেষ্ট। এই হাতে অতি দ্রুতগতিতে সে পরোটা ভাজে। সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো দৃশ্য।
মজনু মিয়া নামকরা কারিগর। তাকে নিয়ে যে কটা রেস্টুরেন্ট শুরু হয়েছে সব ক’টা টিকে গেছে। রমরমা বিজনেস করছে। মজনু মিয়ার নিয়ম হল–কোনো রেস্টুরেন্ট যখন টিকে যায় তখন সে সরে পড়ে। রেস্টুরেন্ট বড় হওয়া মানে নতুন নতুন কারিগরের নিযুক্তি। নতুনদের সঙ্গে তার বনে না। সে কাজ করতে চায় একা। কাজের সময় সে কারো দিকে তাকায় না, কথা বলে না, হ্যাঁ-ই পর্যন্ত না। কাজের সময় সে শুধু ভাবে। ভাবে নিজের একটা রেস্টটুরেন্ট হয়েছে। গমগম করছে রেস্টটুরেন্ট। কাস্টমার আসছে যাচ্ছে। পরোটা ভেজে সে কুল পাচ্ছে না। এই স্বপ্ন সে গত ত্ৰিশ বছরে ধরে দেখছে। আজ সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার মতো ক্ষমতা তার আছে। ত্ৰিশ বছর সে কম টাকা জমায়নি। টাকা না জমিয়েই বা কী করবে? টাকা খরচের তার জায়গা কোথায়? আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই। থাকার আলাদা ঘর। এই জীবনে করা হয়নি। যে রেস্টটুরেন্টে কাজ করেছে সেই রেস্টুরেন্টর বেঞ্চিতেই রাত কাটিয়েছে। নিজের একটি ঘরের প্রয়োজন সে ত্ৰিশ বছর। আগেও বোধ করেনি। আজো করে না।
রেস্টুরেন্ট চালুর দিনে হীরু অসম্ভব উত্তেজনা বোধ করল। তার মনে হচ্ছে কানের পাশ দিয়ে ভো-ভো করে গরম হাওয়া বের হচ্ছে। এই গরম হওয়া শরীরের ভেতরই তৈরি হচ্ছে কিন্তু বের হচ্ছে কোন পথে তা সে ধরতে পারছে না। বুকে হপিণ্ড বেশ শব্দ করেই লাফাচ্ছে। তার হাটের কোনো অসুখ আছে কী-না কে জানে। সম্ভবত আছে। আগে ধরা পড়েনি। এখন ধরা পড়ছে। পীর সাহেব বলে দিয়েছেন, প্রতিদিন দোকান খোলার আগে তিনবার সুরা ফাতেহা এবং তিনবার দরুদ শরীফ পড়তে। লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে হীরুর কোনো দরুদ শরীফ মুখস্থ নেই। ভেবেছিল একটা নামাজ শিক্ষা এনে রাখবে। নামাজ শিক্ষায় সব দোয়া-দরুদ বাংলায় লেখা থাকে। দেখে দেখে তিনবার পড়ে ফেললেই হবে। কিন্তু নানান ঝামেলায় নামাজ শিক্ষা কেনা হয়নি। বিরাট খুঁত রয়ে গেল। হীরু খুবই বিষণু বোধ করল। তার বিষগ্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রথম দিনেই রেস্টুরেন্ট জমে গেল। কারিগর মজনু মিয়ার ভাজি এবং পরোটা দুইই অতি চমৎকার হল। ভাজির রঙ লালাভ, একটু টকটক এবং প্রচণ্ড ঝাল। শুধু খেতেই ইচ্ছা করে। মজনু মিয়া কিছু একটা দিয়েছে সেখানে–কী কে জানে। হীরুর মনে হল ভাজির রান্নার গোপন কৌশল শিখে রাখা দরকার। না শিখে রাখলে পরে সমস্যা হবে। মজনু মিয়া যদি দোকান ছেড়ে যায় তাহলে সে একেবারে পথে বসবে। তার রেস্টটুরেন্টে তখন কেউ থুথু ফেলতেও আসবে না।