তিথির চোখ ভিজে উঠল। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মনে মনে ভাবল, আশ্চর্য এখনো আমার চোখে পানি আসে।
তিথি।
তিথি দেখল হীরু দরজা ধরে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো কারণে অসম্ভব ভয় পেয়েছে। তিথি শুকনো গলায় বলল, কী ব্যাপার?
একটু বাইরে আয়।
যা বলার এখানে বললেই হয়।
না, একটু বাইরে আয়।
তিথি উঠোনে এসে দাঁড়াল। হীরু নিচু গলায় বলল, সৰ্ব্বনাশ হয়েছে রে তিথি। ভেরি বিগ প্রবলেম।
প্রবলেমটা কী?
এ্যান চলে এসেছে।
এ্যানা চলে এসেছে মানে? এ্যানাটা কে?
বলেছিলাম না একটা মেয়ের কথা, আমার সঙ্গে ইয়ে আছে। আজ সকালেই তার গায়ে হলুদ হয়েছে। আর এখন এই সন্ধ্যাবেলা কী গ্রেট ঝামেলা, এক কাপড়ে চলে এসেছে।
চলে এসেছে মানে? তোর কাছে কী ব্যাপার?
আহ্ কী যন্ত্রণা আমাদের মধ্যে একটা Love চলছে না; এখন করি কী বল?
মেয়েটা কোথায়?
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কী যে প্রবলেমে পড়লাম। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়াই তো ভাল। কী বলিস তিথি?
তিথি বিস্মিত হয়ে বাইরে এসে দেখল, কাঁঠাল গাছের অন্ধকারে হলুদ শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কে?
এ্যানা সহজ গলায় বলল, আপা আমি এ্যানা।
তুমি এইসব কী পাগলামি করছ? বাসায় যাও। চল আমি তোমাকে দিয়ে আসি।
বাসায় ফিরে যাবার জন্যে তো আসিনি আপা।
তুমি বিরাট বড় একটা ভুল করছি এ্যানা।
জানি আপা।
আমার তো মনে হয় না তুমি জানো। আমার ভাইকে আমি খুব ভাল করে চিনি। ওর জন্যে তুমি এত বড় ডিসিশান নিতে পার না।
হীরু শুকনো মুখে বলল, তিথি রাইট কথা বলছে। ভেরি রাইট এবং ওয়াইজ কথা।
এ্যানা বিরক্তমুখে বলল, তোমাকে কত বার বলেছি কথার মধ্যে মধ্যে বিশ্ৰী ভাবে ইংরেজি বলবে না।
এই প্রথম এ্যানা হীরুকে তুমি করে বলল। হীরুর বুক কেমন ধড়ফড় করতে লাগল। চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছে। কী করা যায়? মেয়েটাকে খুশি করবার জন্যে সে অনেক কিছু করতে পারে। হাসিমুখে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ডান হাতটা কেটে পানিতে ফেলে দিতে পারে।
তিথি বলল, এখনো সময় আছে এ্যানা। এখনো সময় আছে।
এ্যানা মিষ্টি করে হাসল। মেয়েটা দেখতে তত সুন্দর না। কিন্তু তার হাসিটি বড়ই স্নিগ্ধ। তিথি বলল, এখন যে কত রকম ঝামেলা হবে তুমি কল্পনাও করতে পারছি না। তোমার বাবা পুলিশে খবর দেবেন। পুলিশ আসবে, তোমাকে এবং হীরুকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাব। এ্যানা বলল,
এইসব কিছুই হবে না আপা। আমি বাসায় না বলে তো আসিনি। বলেই এসেছি। সবাই জানে ভূমিকাথায়। কেউ কোনো ঝামেলা করবে না। কারণ আমি তাদের এমন একটা কথা বলে এসেছি…
কথা শেষ না করেই এ্যানা হাসল। তিথি বলল, কী কথা বলে এসেছ?
এটা আপা বলা যাবে না।
এস ঘরে এস।
এ্যানা জালালুদ্দিন সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল। জালালুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, কে? এ্যানা বলল, বাবা আমার নাম এ্যানা। আমি আপনার একজন মেয়ে।
জালালুদ্দিন হকচকিয়ে গেলেন। কী ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, মা আপনার শরীর কেমন?
এ্যানা বলল, আমার শরীর ভাল।
মিনুকে সালাম করতে যেতেই মিনু বললেন, খবরদার তুমি আমার পায়ে হাত দিও না।
এ্যানা সহজ গলায় বলল, আমার সঙ্গে এমন কঠিন করে কথা বললে তো হবে না মা। আমি এই বাড়িতেই থাকব। আমাদের তো মিলেমিশে থাকতে হবে। হবে না?
রাত সাড়ে দশটায় কাজী এনে বিয়ে পড়ানো হল। এ্যানার বাবাকে খবর দেয়া হল। আশ্চর্যের ব্যাপার–তিনি বিয়েতে এলেন। হীরু যখন তাকে সালাম করল তখন হীরুকে একটা আংটি এবং দুশ টাকা দিলেন।
টাকাটা পাওয়ায় হীরুর খুব লাভ হল। তার হাতে একটা পয়সা ছিল না। কেন জানি তার মনে হল এ্যানা খুব পয়মন্ত মেয়ে। এইবার সংসারের হাল ফিরবে।
এ্যানা টি স্টল
হীরুর খুব ইচ্ছা ছিল তার চায়ের দোকানের নাম রাখবে এ্যানা টি স্টল। এ্যানার কারণে তা হল না। এ্যানা কঠিন গলায় বলল, ফাজলামি করবে না তো। ফাজলামি করলে চড় খাবে। হীরু অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বলল, চড় খাব মানে? এটা কী ধরনের কথা! ওয়াইফ হয়ে হাসবেন্ডকে চড় দেয়ার কথা বলছি। সান কী আজ পূর্বদিকে রাইজ করল?
হ্যাঁ, করল। চায়ের দোকানের কোনো নাম লাগবে না।
একটা দোকান দেব তার নাম থাকবে না?
না। পাঁচ পয়সা দামের দোকান তার আবার নাম।
পাঁচ পয়সা দামের দোকান মানে? নগদ চার হাজার সাতশ টাকা নিজের পকেট থেকে দিলাম।
নিজের পকেট থেকে তুমি একটা পয়সাও দাওনি। তিথি আপা টাকাটা দিয়েছে।
একই হল।
না একই হয়নি। এখন যাও–যথেষ্ট বকবক করেছ।
হীরু মন খারাপ করে বের হয়ে এল। তার এখন সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে এই মেয়েকে বিয়ে করে গ্রেট ভুল করা হয়েছে। এই মেয়ে তার জীবনটা ভাজা ভাজা করে ফেলবে। দিনরাত ঝগড়া করবে। ঘরের চালে কাক-পক্ষী বসতে দেবে না।
মিনুর সঙ্গে এ্যানার বড় রকমের একটা ঝগড়া হয়ে গেল। তিন দিন না পেরুবার আগেই। এ্যানা রান্নাঘরে ভাত বসিয়েছে। মিনু বললেন–কী করছ?
ভাত বসিয়েছি। তোমাকে ভাত বসাতে বলেছি? না, বলেননি। বলতে হবে কেন? আপনার কী ধারণা আমি ভাত রাঁধতে জানি না?
মিনু স্তম্ভিত গলায় বললেন, এ রকম করে কথা বলা তোমাকে কে শিখিয়েছে?
কেউ শেখায়নি। ভাত বসিয়েছি তা নিয়ে আপনিই বা এত হৈচৈ করছেন কেন?
মিনু চাপা গলায় বললেন, তুমি তো ভয়ংকর বদ মেয়ে।