টুকু কোনো কথা না বলে খাট থেকে নেমে গেল। তার বয়স তের। কিন্তু দেখে মনে হয়৷ ন’দশ। শরীর খুবই দুর্বল। কিছু দিন পরপরই অসুখে পড়ছে। আজ জ্বরের জন্যে সে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বারান্দায় বালতিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা। টুকু মগ ডুবিয়ে পানি তুলছে। বরফ শীতল সেই পানিতে মুখ ধুতে গিয়ে শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিশ্চয়ই এখনো গায়ে জ্বর আছে। নয় তো পানি এত ঠাণ্ডা লগত না। মুখে পানি ঢালতে ঢালতে সে তিথির দিকে তাকাল। আপাকে কি সুন্দর লাগছে! আপা আর একটু ফর্সা হলে কি অদ্ভুত হত!
তিথি বলল, টুকু আমাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিবি?
টুকু মাথা নাড়ল। ভেতর থেকে জালালুদ্দিন ডাকলেন তিথি, শুনে যা তো মা।
তিথি বারান্দা থেকে নড়ল না। সেখান থেকেই বলল কি বলবে বল।
এই সন্ধ্যাবেলা কোথায় বেরুচ্ছিস? কি রকম ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে দেখছিস না।
আমার কাজ আছে।
ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কিসের কাজ? বাদ দে।
সে জবাব দিল না। জালালুদ্দিন বললেন, খবরদার বেরুবি না। কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। মানুষ কী পিঁপড়া নাকি যে রাতদিন কাজ করবে।
মিনু ঝাঁঝাল গলায় বললেন, চুপ কর। সব সময় কথা বলবে না।
এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে নাকি?
তোমাকে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
বৃষ্টিতে ভিজে একটা জ্বরজ্বারি বাঁধাবে…সিজন চেঞ্জ হচ্ছে।
বললাম তো তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
তিথি যখন বেরুল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিক অন্ধকার। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সে ঘর থেকে বেরুবার সময় কাউকে কিছু বলে বেরুল না। মিনু বারান্দাতেই ছিলেন তার দিকে তাকিয়ে একবার বললও না মা, যাচ্ছি। যেন সে তাকে দেখতেই পায়নি।
ঘরে ছাতা নেই। তিথি মোটা একটা তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে রাস্তায় নেমেছে। খালি পা। স্যান্ডেল জোড়া হাতে। কাঁচা রাস্তা, খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। টুকু আগে আগে যাচ্ছে। তার মাথায় কিছু নেই। বৃষ্টিতে মাথার চুল এর মধ্যেই ভিজে জবজবে। তিথি বলল, বাসায় গিয়ে ভাল করে মাথা মুছে ফেলবি। নয় তো জ্বরে পড়বি।
টুকু মাথা কাত করল। মৃদু গলায় বলল, রাতে ফিরবে না। আপা?
না।
সকালে আসবে?
হুঁ। এবার বর্ষা আগেভাগে এসে গেল তাই না রে টুকু। মনে হচ্ছে শ্রাবণ মাস। তাই না?
হুঁ।
গতবারের মত এবারও ঘরে পানি উঠবে কি-না কে জানে। তোর কি মনে হয় উঠবে?
টুকু জবাব দিল না। তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
কলাবাগানের ভেতরের দিকে একটা বাড়ির সামনে তিথি এসে উপস্থিত হয়েছে। তার শাড়ি কাদা-পানিতে মাখামাখি। হোচট খেয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেছে। নখের খানিকটা ভেঙে যাওয়ায় রক্ত পড়ছে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর মাঝবয়েসী এক লোক দরজা খুলল। তার খালি গা। হাঁটু পর্যন্ত উঁচুতে লুঙ্গি উঠে আছে। পরার ধরন এমন মে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে খুলে পড়ে যাবে। তার কোলে তিন-চার বছরের একটি বাচ্চা। ভদ্রলোক বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছেন। বাচ্চা ঘুমুচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম করে থাকে আবার মাথা তুলে হিক জাতীয় বিচিত্র শব্দ করে।
তিথি বলল, নাসিম ভাই কেমন আছেন? নাসিম বিরক্ত গলায় বলল, এই তোমার বিকাল পাঁচটা, কটা বাজে তুমি জানো?
তিথি চুপ করে রইল।
নাসিম বলল, আটটা পঁচিশ।
তিথি হালকা গলায় বলল, দূরে থাকি। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। তাই দেরি হল।
দূরে তুমি একা থাক নাকি? অন্যরা থাকে না? কতবার বললাম খুব ভাল পার্টি হাজার খানিক টাকা পেয়ে যাবে। বেশিও দিতে পারে। নতুন পয়সা-হওয়া পার্টি। এদের টাকার মা-বাপ আছে? উপকার করতে চাইলে এই অবস্থা।
ভেতরে আসতে দিন নাসিম ভাই। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে জ্বর এসে যাচ্ছে।
আস আস, ভেতরে আস। পা কেটেছে নাকি?
হুঁ।
ইস, রক্ত বের হচ্ছে দেখি। যাও, বাথরুমে ঢুকে শাড়ি বদলে ফেল। তোমার ভাবীকে বল শাড়ি দিবে। আজ রাতে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না। ভাল একটা পার্টি চলে গেল।
আজ তাহলে চলে যাব?
ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায়? কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন? বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে মুশকিলে পড়বে।
নাসিম ভাই এখানে কোনো জায়গা থেকে একটা টেলিফোন করা যাবে?
কোথায় টেলিফোন করবে?
তিথি চুপ করে রইল। নাসিম বলল, শোন তিথি একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন পার্টির সাথে বাড়তি খাতির রাখবে না। যত দূরে থাকা যায়। ফেল কড়ি মাখ তেল। এর বেশি কিছু নয়।
সে রকম কিছু না নাসিম ভাই।
সে রকম কিছু না হলেই ভাল।
নাসিম গলা উঁচিয়ে বলল বীনা, কই চা দাও দেখি। ঘরে স্যাভলন-ট্যাভলিন আছে? বাথরুমের তাকে দেখ তো। আর এক বান্দরের বাচ্চা তো ঘুমাচ্ছে না। ইচ্ছা করছে আছাড় দিয়ে পেটটা গালিয়ে দেই। চুপ, কানবি না। একদম চুপ।
রীনা এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে গেল। একবার শুধু সরু চোখে দেখল তিথিকে। আগেও অনেকবার দেখেছে কখনো কথা হয়নি। আজও হল না। রীনার বয়স ষোল-সতের। এর মধ্যে দু’টি বাচ্চার মা হয়েছে। তৃতীয় বাচ্চা আসার সময়ও প্রায় হয়ে এল। রোগা শরীরের কারণে তার সন্তানধারণজনিত শারীবিক অস্বাভাবিকতা খুবই প্রকট হয়ে চোখে পড়ে।
নাসিম বলল, এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, ভেতরে গিয়ে শাড়ি বদলে আস। পায়ে কিছু দাও।
শাড়ি বদলাব না চলে যাব।
এত রাতে?
রাত বেশি হয়নি। বাস আছে।
রাতিবিরাতে এরকম চলাফেরা ভাল না, কখন কোন বিপদ হয়।
রীনা চা নিয়ে এসেছে। এত দ্রুত সে চা বানাল কি করে কে জানে। মেয়েটা খুবমই কাজের। তিথির চা খেতে ইচ্ছা করছে না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। জ্বর আসবে কি-না কে জানে। নাসিম পিরিচে ঢেলে বড় বড় চুমুকে চা খাচ্ছে। প্রতিবার চুমুক দিয়ে আহ করে একটা শব্দ করছে। সামান্য চায়ে এত তৃপ্তি। কিছু কিছু মানুষ খুব অল্পতে সুখী হয়।