হীরু গম্ভীর গলায় বলল, তোরা কোথায় যাচ্ছিস?
তিথি জবাব দিল না। যেমন হাঁটছিল তেমনি হাঁটতে লাগল। যেন সে এই মানুষটাকে চেনে না। এ যেন রাস্তার একজন মানুষ। পরিচিত কেউ নয়।
কি রে, কথা বলছিস না কেন?
তোর সঙ্গে কথা বলার কিছু আছে?
আরে কি মুশকিল, এত রেগে আছিস কেন? বৃষ্টি-বাদলা দিনে এত রাগ ভাল না। বাসায় চল। বাসায় গিয়ে কী হবে?
হবে। আবার কী? গরম গরম ভাত আর ইলিশ মাছ ফ্রাই খাবি। চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনলাম। এমনিতে সত্তর টাকা দাম। বৃষ্টি-বাদলা বলে বাজারে লোক নেই। পানির দামে সব ছেড়ে দিচ্ছে।
তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না। বাসায় যা। বাসায় গিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা খা।
রাতে ফিরবি তো? ফিরলে কখন ফিরবি বলে যা, বাস স্ট্যান্ডে থাকব। দিনকাল ভাল না।
আমার জন্যে কাউকে দাঁড়াতে হবে না। আর একটা কথা বললে আমি কিন্তু চড় লাগাব। ফাজিল কোথাকার। চোরের চোর।
আরে কি মুসিবত, মুখ খারাপ করছিস কেন? আমি তোর সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করছি, তুই আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করবি। আমি কী গালাগালি করছি?
চুপ কর।
ধমক দিচ্ছিস কেন? তোর বড় ভাই হই মনে থাকে না? সংসারকে দু’টা পয়সা দিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিস। পয়সা কিভাবে আনছিস সেটা বুঝি আমি জানি না? এই শর্মা মায়ের বুকের দুধ খান না। সব বুঝে। তোর ঐ পয়সায় আমি পেচ্ছাব করে দেই। আই মেক ওয়াটার। বুঝলি ওয়াটার। আমার স্ট্রেইট কথা। পছন্দ হলে হবে। না হলে–নো প্রবলেম।
তিথি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। হীরু লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা হল।
বারান্দায় উঠেই সে সহজ গলায় বলল মা, মাছটা ধর তো। তার বলার ভঙ্গি থেকে মনে হতে পারে সে কিছুক্ষণ আগে মাছ কেনার জন্যেই গিয়েছিল। কিনে ফিরেছে।
মিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। হীরু মার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, ঘরে সর্ষে আছে মা? যদি থাকে, সর্ষে বাটা লাগিয়ে দাও। কুমড়ো পাতা খোঁজ করছিলাম। পাইনি। পেলে পাতুরি করা যেত। বর্ষা-বাদলার দিনে পাতুরির মত জিনিস হয় না।
মিনু শান্ত কণ্ঠে বললেন, তুই বেরিয়ে যা। হীরু অবাক হয়ে বলল, কোথায় বেরিয়ে যাব?
যেখানে ইচ্ছ যা। এই বাড়িতে তোকে দেখতে চাই না।
ঠিক আছে যেতে বলছি যাব।
এক্ষুণি যা।
আচ্ছা ঠিক আছে। মাছটা সখ করে এনেছি, রান্নাবান্না কর খেয়ে তারপর যাই। এক ঘণ্টা আগে গেলেও যা পরে গেলেও তা।
মিনু মাছ উঠোনের কাদার মধ্যে ছুড়ে ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। হীরু উঁচু গলায় বলল, আমার ওপর রাগ করছ কর মাছের ওপর রাগ করছে কেন? এই বেচারা তো কোনো দোষ করেনি। একের অপরাধে অন্যের শাস্তি এটা কি রকম বিচার?
মিনু রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন ঘরে ঢুকলে বঁটি দিয়ে তোকে চাকা চাকা করে ফেলব। খবরদার! হীরুর তেমন কোনো ভাবান্তর হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হীরুকে দেখা গেল। গামছা লুঙ্গির মত করে পরে বঁটি দিয়ে অন্ধকারে মাছ কুটতে বসেছে। কথা বলছে নিজের মনে। এমন ভাবে বলছে যেন রান্নাঘর থেকে মিনু শুনতে পান।
সব কিছু না শুনেই রাগ। আরে আগে ঘটনাটা কি ঘটেছে শুনতে হবে না? না শুনেই চিৎকার, চেঁচামেচি। চাল কিনতে বাজারে ঢুকেছি। নাজিরশাল চাল। দেখেশুনে পছন্দ করলাম। বস্তার মধ্যে নিলাম বিশ সের। টাকা দিতে দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি পরিষ্কার। সাফা করে দিযেছে। চাল না নিয়ে বাসায় ফিরি কিভাবে? চক্ষু লজ্জার ব্যাপার আছে না? গোলাম রশীদের কাছে টাকা ধার করতে। সেইখানে গিয়ে দেখি রশীদ শালা টেম্পোর সঙ্গে একসিডেন্ট করে এই মরে সেই মরে. গোলাম হাসপাতালে, দিলাম ব্লাড। ব্লাড দেয়ার পরে দেখি নিজের অবস্থা কাহিল। ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছি, সিস্টার এসে ধরল…
মিনু রান্নাঘর থেকে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ নিয়ে বের হলেন। শীতল স্বরে বললেন আর একটা কথা না। হীরু চুপ করে গেল।
জালালুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, খালি পেটে চা খাওয়াটা ঠিক হবে না। আলসার ফালসার হয়। ঘরে আর কিছু আছে?
মুড়ি আছে। মুড়ি মেখে দেব?
থাকলে দাও। খিদে খিদে লাগছে।
ঐ একটা জিনিসই তো তোমার লাগে ক্ষিধা। সকালে ক্ষিধা, বিকালে ক্ষিধা, সন্ধ্যায় ক্ষিধা।
মিনু আবার রান্নাঘরে ঢুকলেন। চাপা স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলেন, এর নাম সংসার। স্বামীপুত্র-কন্যার সুখের সংসার। এত সুখ আমার কপালে। আমি হলাম গিয়ে সুখের রানী চম্পাবতী।
জালালুদিনের চোখ এখন বন্ধ। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ করকার করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তিনি হাতড়ে হাতড়ে চায়ের কাপ নিলেন। চুমুক দিয়ে তৃপ্তির একটা শব্দ করলেন। নরম স্বরে ডাকলেন ও টুকু। টুকুন রে।
টুকু জবাব দিল না। বিনা কারণে মার খেয়ে তার মন খুব খারাপ হয়েছে। সে বসে আছে গম্ভীর মুখে। জালালুদ্দিন আবার ডাকলেন, ও টুকু। ও টুকুন।
কী?
চোখটা মনে হচ্ছে সেরেই গেছে। খানিক্ষণ আগে তিথিকে দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম। শাড়ির রঙটা অবশ্য ধরতে পারিনি।
টুকু কিছুই বলল না।
তিনি তাতে খুব একটা ব্যথিত হলেন না। এ বাড়িতে বেশির ভাগ লোক তাঁর সঙ্গে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। তার এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
ও টুকু?
কী?
মাগরেবের আজান হয়েছে?
জানি না।
চা খাবি? পিরিচে ঢেলে দেই? জ্বরের মধ্যে চা ভাল লাগবে। ওষুধের মত কাজ করবে। পাতার রসটা ডাইরেক্ট আসছে। কুইনিন কী জিনিস? গাছের বাকলের রস। গাছের রস। খুবই উপকারী।