- বইয়ের নামঃ জনম জনম
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
তিথি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে
তিথি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কেন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্যি আঠার-উনিশ বছরের মেয়েরা বিনা কারণেই আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তিথির বয়স একুশ। সেই হিসেবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার একটা অর্থ করা যেতে পারে। এই বয়সের মেয়েরা অন্যের মাঝে নিজের ছায়া দেখতে ভালবাসে। যে কারণে পুকুর দেখলেই পুকুরের পানির উপর ঝুঁকে পড়ে। আয়নার সামনে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখতে বড় ভাল লাগে।
তিথির বয়স একুশ হলেও এইসব যুক্তি তার বেলায় খাটছে না। কারণ ঘর অন্ধকার। আয়নায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও বাইরে শেষ বেলার আলো এখনো আছে। সেই আলোর খানিকটা এ ঘরে আসা উচিত। কিন্তু আসছে না। বৃষ্টির মধ্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সারাদিন অবিশ্রান্ত বর্ষণ হয়েছে। এখন বৃষ্টি নেই। দরজা-জানালা অবশ্যি খোলা হয়নি। কারণ আবার বৃষ্টি আসবে। আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে।
এই ঘরে সে ছাড়াও আরো একজন মানুষ আছে, তার বাবা শিয়ালজানি হাই স্কুলের রিটায়ার্ড অ্যাসিসেটেন্ট হেড মাস্টার জালালুদ্দিন সাহেব। জালালুদ্দিন সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। খানিকক্ষণ আগে তার ঘুম ভেঙেছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে সমস্যা আছে। চোখ প্রায় নষ্ট। কিছুই দেখতে পান না। কড়া রোদে আবছা আবছা কিছু দেখেন। সত্যি দেখেন না কল্পনা করে নেন তা বোঝা মুশকিল। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি তার বড় মেয়েকে এই অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছেন। শ্যামলা মেয়েটির বালিকাদের মত সরল মুখ, বড় বড় চোখ সব তিনি পপিন্ধাব দেখতে পাচ্ছেন। কী আশ্চৰ্য্য কাণ্ড।
জালালুদ্দিন সাহেব প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করলেন। তার চোখ কি তাহলে সেরে গেল নাকি? গত সাতদিন ধরে একটা কবিরাজি ওষুধ তিনি চোখে দিচ্ছেন নেত্র সুধা! ওষুধটা মনে হচ্ছে কাজ করেছে। জালালুদ্দিন চিকন গলায় ডাকলেন, ও তিথি।
তিথি বাবার দিকে ফিবে তাকাল। কিছু বলল না।
চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি রে মা! তোর পরনে একটা লাল শাড়ি না? পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
তিথি বলল, শাড়ির রঙ নীল। বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আজ সে বাইরে যাবে। বাইরে যাবার আগে কারো সঙ্গে কথা বলতে তার ভাল লাগে না।
তিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বইল আবার বৃষ্টি আসবে কি না বুঝতে চেষ্টা করল। বৃষ্টি আসুক বা না। আসুক তাকে বেরুতেই হবে। সে রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরে তিথির মা মিনু চুলা ধরানোর চেষ্টা করছেন। কাঠ ভেজা। কিছুতেই আগুন ধরছে না। বোতল থেকে কেরোসিন ঢাললেও লাভ হয় না। ধপ করে জ্বলে উঠে কিছুক্ষণ পর আগুন নিভে যায়। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বেরুতে থাকে। তিথি একটা মোড়ায় বসে মাকে দেখছে। মিনু বিরক্ত গলায় বললেন তুই বসে বসে ধোঁয়া খাচ্ছিস কেন? বারান্দায় গিয়ে বোস। তিথি নিঃশব্দে উঠে এলো। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আবার বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। ঘোর বর্ষা।
তাদের বাসাটা কল্যাণপুর ছাড়িয়েও অনেকটা দূরে। জায়গাটার নাম সুতাখালি। পুরোপুরি গ্রাম বলা যায়। চারদিকে ধানি জমি। তবে ঢাকা শহরে লোকজন বেশির ভাগ জমিই কিনে ফেলেছে। তিন ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে সাইনবোর্ড বুলিয়ে দিয়েছে দিস প্রপার্টি বিলংস টু. দেয়াল ঘেরা অংশে পানি থৈ থৈ করে। পানির বুক চিরে যখন-তখন হলুদ রঙের সাপ সাঁতরে যায়। জায়গাটায় সাপখোপের খুব উপদ্রব। তবে অবস্থা নিশ্চয়ই এ রকম থাকবে না। তিন-চার বছরের মধ্যেই চার-পাঁচতলা দালান উঠে যাবে। ইলেকট্রিসিটি গ্যাস চলে আসবে। সন্ধ্যাবেলা চারদিক ঝলমল করবে। তিন কামরার একটি বাড়ির ভাড়া তিন-চার হাজার টাকা। তিথিদের এই বাড়িটার ভাড়া মাত্র ছ’শ। রান্নাঘর ছাড়াই তিনটা কামরা আছে। এক চিলতে বারান্দা আছে। করোগেটেড টিনের শিটের বেড়া দিয়ে ঘেরা। রান্নাঘরের পাশে তিনটা পেঁপে গাছ আছে। তিনটা গাছেই প্রচুর পেঁপে হয়। ছ’শ টাকায় এ-ই বা মন্দ কী?
মিনু চায়ের কাপ দিয়ে বারান্দায় এসে বিরক্ত মুখে বলল, আবার বৃষ্টি নামল! এই বৃষ্টির মধ্যে যাবি কিভাবে? তিথি জবাব দিল না। আকাশের মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ দেখতে সব মেয়েরই বোধ হয় ভাল লাগে। তিথির চোখে-মুখে এক ধরনের মুগ্ধতা।
মিনু বললেন, চায়ে চুমুক দিয়ে দেখ মিষ্টি লাগবে কি-না।
চা খাব না। মা। বাবাকে দিয়ে দাও।
তোর বাবার জন্যে তো বানিয়েছি, তুই খা।
ইচ্ছা করছে না। শরীর খারাপ নাকি রে?
না। শরীর ভালই আছে। টুকু ঘরে আছে কি-না দেখ তো মা। আমাকে এগিয়ে দেবে। টুকু ঘরে ছিল। বাবার সাথে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিল। মিনু চাদর সরিয়ে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন–হারামজাদা বান্দর। সন্ধ্যাবেলায় ঘুম। টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব।
জালালুদ্দিন বিড়বিড় করে বললেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মারধর করা ঠিক না। ব্ৰেইনে এফেক্ট করে।
মিনু তীব্র গলায় বললেন তুমি চুপ করে থাক। তোমাকে মারধর করা হয়নি। সামনে চায়ের কাপ আছে ফেলে একাকার করবে না।
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাবার আগেই হীরুকে দেখা গেল পানিতে ছপছপ শব্দ করতে করতে আসছে। হীরু তিথির এক বছরের বড়। মুখ ভর্তি গোঁফ দাড়ির জঙ্গলের জন্য বয়স অনেক বেশি মনে হয়। হীরুর এক হাতে দড়িতে বাধা ইলিশ মাছ। অন্য হাতে টর্চ। ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় ঝাপসামত আলো বেরুচ্ছে। হীরু পাঁচদিন আগে আধমণ চাল কিনবার টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। আজ ফিরছে। তিথি না দেখার ভান করল।