ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে যাহা হইয়াছে হইয়াছে, ও কথা আর তুলিবেন না— মনে করিলেও আমার গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে।”
খুড়া কহিলেন, “যদি অনুমতি করেন তবে মেয়েটিকে আপনার কাছে রাখিয়া এখন বিদায় হই। মাঝে মাঝে আসিয়া দেখিয়া যাইব। ইঁহার একটি বড়ো বোন আছে, সেও আপনাকে প্রণাম করিতে আসিবে।”
খুড়া চলিয়া গেলে ক্ষেমংকরী কমলাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “এসো তো মা, দেখি। তোমার বয়স তো বেশি নয়। আহা, তোমাকে ফেলিয়া যাইতে পারে, জগতে এমন পাষাণও আছে ! আমি আশীর্বাদ করিতেছি, সে আবার ফিরিয়া আসিবে। বিধাতা এত রূপ কখনো বৃথা নষ্ট করিবার জন্য গড়েন নাই।”
বলিয়া কমলার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির দ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এখানে তোমার সমবয়সী সঙ্গিনী কেহ নাই, একলা আমার কাছে থাকিতে পারিবে তো ?”
কমলা তাহার দুই বড়ো বড়ো স্নিগ্ধ চক্ষে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করিয়া কহিল, “পারিব মা !”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তোমার দিন কাটিবে কী করিয়া আমি তাই ভাবিতেছি।”
কমলা কহিল, “আমি তোমার কাজ করিব।”
ক্ষেমংকরী। পোড়াকপাল ! আমার আবার কাজ ! সংসারে ঐ তো আমার একটিমাত্র ছেলে, সেও সন্ন্যাসীর মতো থাকে— কখনো যদি বলিত ‘মা, এইটে আমার দরকার আছে, আমি এইটে খেতে চাই, আমি এইটে ভালোবাসি’, তবে আমি কত খুশি হইতাম— তাও কখনো বলে না। রোজগার ঢের করে, হাতে কিছুই রাখে না ; কত সৎকাজে যে কত দিকে খরচ করে তাহা কাহাকে জানিতেও দেয় না। দেখো বাছা, আমার কাছে যখন তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা থাকিতে হইবে তখন এ কথা আগে হইতেই বলিয়া রাখিতেছি, আমার মুখে আমার ছেলের গুণগান বার বার শুনিয়া তোমার বিরক্ত ধরিবে, কিন্তু ঐটে তোমাকে সহ্য করিয়া যাইতে হইবে।
কমলা পুলকিতচিত্তে চক্ষু নত করিল।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি তোমাকে কী কাজ দিব, তাই ভাবিতেছি। সেলাই করিতে জান।”
কমলা কহিল, “ভালো জানি না মা !”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমাকে সেলাই শিখাইয়া দিব।”
ক্ষেমংকরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “পড়িতে জান তো ?”
কমলা কহিল, “হাঁ, জানি।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে হইল ভালো। চোখে তো আর চশমা নহিলে দেখিতে পাই না, তুমি আমাকে পড়িয়া শোনাইতে পারিবে।”
কমলা কহিল, “আমি রাঁধাবাড়া ঘরকন্নার কাজ সমস্ত শিখিয়াছি।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “অমন অন্নপূর্ণার মতো চেহারা, তুমি যদি রাঁধাবাড়ার কাজ না জানিবে তো কে জানিবে। আজ পর্যন্ত নলিনকে আমি নিজে রাঁধিয়া খাওয়াইয়াছি— আমার অসুখ হইলে বরঞ্চ স্বপাক রাঁধিয়া খায়, তবু আর কাহারো হাতে খায় না। এবার হইতে তোমার কল্যাণে তাহার স্বপাক খাওয়া আমি ঘোচাইব। আর, অক্ষম হইয়া পড়িলে আমাকেও যদি চারটিখানি হবিষ্যান্ন রাঁধিয়া খাওয়াও তো আমার তাহাতে অনভিরুচি হইবে না। চলো মা, তোমাকে আমার ভাঁড়ার-ঘর রান্নাঘর সমস্ত দেখাইয়া আনি।”
এই বলিয়া ক্ষেমংকরী তাঁহার ক্ষুদ্র ঘরকন্নার সমস্ত নেপথ্যগৃহ কমলাকে দেখাইলেন। কমলা ইতিমধ্যে একটা অবকাশ বুঝিয়া আস্তে আস্তে আপনার দরখাস্ত জারি করিল। কহিল, “মা, আমাকে আজকে রাঁধিতে দাও-না।”
ক্ষেমংকরী একটুখানি হাসিলেন। কহিলেন, “গৃহিণীর রাজত্ব ভাঁড়ারে আর রান্নাঘরে— জীবনে অনেক জিনিস ছাড়িতে হইয়াছে, তবু ওটুকু সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়াই আছে। তা মা, আজকের মতো তুমিই রাঁধো— দুই-চারিদিন যাক, ক্রমে সমস্ত ভার আপনিই তোমার হাতে পড়িবে, আমিও ভগবানে মন দিবার সময় পাইব। বন্ধন একেবারেই তো কাটে না— এখনো দুই-চারিদিন মন চঞ্চল হইয়া থাকিবে, ভাঁড়ার ঘরের সিংহাসনটি কম নয়।”
এই বলিয়া ক্ষেমংকরী, কী রাঁধিতে হইবে, কি করিতে হইবে, কমলাকে সমস্ত উপদেশ দিয়া পূজাগৃহে চলিয়া গেলেন। ক্ষেমংকরীর কাছে আজ কমলার ঘরকন্নার পরীক্ষা আরম্ভ হইল।
কমলা তাহার স্বাভাবিক তৎপরতার সহিত রন্ধনের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত করিয়া, কোমরে আঁচল জড়াইয়া, মাথায় এলোচুল ঝুঁটি করিয়া লইয়া রাঁধিতে প্রবৃত্ত হইল।
নলিনাক্ষ বাহির হইতে বাড়িতে ফিরিলেই প্রথমে তাহার মাকে দেখিতে যাইত। তাহার মাতার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে চিন্তা তাহাকে কখনোই ছাড়িত না। আজ বাড়িতে প্রবেশ করিবামাত্র রান্নাঘরের শব্দ এবং গন্ধ তাহাকে আক্রমণ করিল। মা এখন রান্নায় প্রবৃত্ত আছেন মনে করিয়া নলিনাক্ষ রান্নাঘরের দরজার সামনে আসিয়া উপস্থিত হইল।
পদশব্দে চকিত কমলা পিছন ফিরিয়া চাহিতেই একেবারে নলিনাক্ষের সহিত তাহার চোখে চোখে সাক্ষাৎ হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি হাতাটা রাখিয়া ঘোমটা টানিয়া দিবার বৃথা চেষ্টা করিল— কোমরে আঁচল জড়ানো ছিল— টানাটানি করিয়া ঘোমটা যখন মাথার কিনারায় উঠিল বিস্মিত নলিনাক্ষ তখন সেখান হইতে চলিয়া গেছে। তাহার পর কমলা যখন হাতা তুলিয়া লইল তখন তাহার হাত কাঁপিতেছে।
পূজা সকাল-সকাল সারিয়া ক্ষেমংকরী যখন রান্নাঘরে গেলেন, দেখিলেন, রান্না সারা হইয়া গেছে। ঘর ধুইয়া কমলা পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছে; কোথাও পোড়াকাঠ বা তরকারির খোসা বা কোনোপ্রকার অপিরচ্ছন্নতা নাই। দেখিয়া ক্ষেমংকরী মনে মনে খুশি হইলেন; কহিলেন, “মা, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে বটে।”
নলিনাক্ষ আহারে বসিলে ক্ষেমংকরী তাহার সম্মুখে বসিলেন; আর-একটি সংকুচিত প্রাণী কান পাতিয়া দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল, উঁকি মারিতে সাহস করিতেছিল না— ভয়ে মরিয়া যাইতেছিল, পাছে তাহার রান্না খারাপ হইয়া থাকে।