রাজা সচকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন সহাস্য সৌম্যমূর্তি বিল্বন। তাঁহাকে প্রণাম করিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “আজ আমার কী আনন্দ।”
বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ, আপনাকে জয় করিয়াছেন বলিয়া সকলকেই জয় করিয়াছেন। তাই আজ আপনার দ্বারে শত্রুমিত্র সকলে একত্র হইয়াছে।”
ফকির অগ্রসর হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, আমিও তোমার শত্রু, আমিও তোমার হাতে ধরা দিলাম।”
রঘুপতির দিকে আঙুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন, “এই ব্রাহ্মণ-ঠাকুর আমাকে জানেন। আমিই সুজা, বাংলার নবাব, আমিই তোমাকে বিনাপরাধে নির্বাসিত করিয়াছি এবং সে পাপের শাস্তিও পাইয়াছি–আমার ভ্রাতার হিংসা আজ পথে পথে আমার অনুসরণ করিতেছে, আমার রাজ্যে আমার আর দাঁড়াইবার স্থান নাই। ছদ্মবেশে আমি আর থাকিতে পারি না তোমার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়া আমি বাঁচিলাম।”
তখন রাজা ও নবাব উভয়ে কোলাকুলি করিলেন। রাজা কেলবমাত্র কহিলেন, “আমার কী সৌভাগ্য!”
রঘুপতি কহিলেন, “মহারাজ, তোমার সহিত শত্রুতা করিলেও লাভ আছে। তোমার শত্রুতা করিতে গিয়াই তোমার কাছে ধরা পড়িয়াছি, নহিলে কোনোকালে তোমাকে জানিতাম না।”
বিল্বন হাসিয়া কহিলেন, “যেমন ফাঁসের মধ্যে পড়িয়া ফাঁস ছিঁড়িতে গিয়া গলায় আরও অধিক বাধিয়া যায়।”
রঘুপতি কহিলেন, “আমার আর দুঃখ নাই–আমি শান্তি পাইয়াছি।”
বিল্বন কহিলেন, “শান্তি সুখ আপনার মধ্যেই আছে, কেবল জানিতে পাই না। ভগবান এ যেন মাটির হাঁড়িতে অমৃত রাখিয়াছেন, অমৃত আছে বলিয়া কাহারও বিশ্বাস হয় না। আঘাত লাগিয়া হাঁড়ি ভাঙিলে তবে অনেক সময়ে সুধার আস্বাদ পাই। হায় হায়, এমন জিনিসও এমন জায়গায় থাকে!”
এমন সময়ে একটা অভ্রভেদী হো হো শব্দ উঠিল। দেখিতে দেখিতে দুর্গের মধ্যে ছোটোবড়ো নানাবিধ ছেলে আসিয়া পড়িল। রাজা বিল্বনকে কহিলেন, “এই দেখো ঠাকুর, আমার ধ্রুব।” বলিয়া ছেলেদের দেখাইয়া দিলেন।
বিল্বন কহিলেন, “যাহার প্রসাদে তুমি এতগুলি ছেলে পাইয়াছ সেও তোমাকে ভোলে নাই, তাহাকেও আনিয়া দিই।” বলিয়া বাহিরে গেলেন। কিঞ্চিৎ বিলম্বে ধ্রুবকে কোলে করিয়া আনিয়া রাজার কোলে দিলেন। রাজা তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া ডাকিলেন, “ধ্রুব!”
ধ্রুব কিছুই বলিল না, গম্ভীর ভাবে নীরবে রাজার কাঁধে মাথা দিয়া পড়িয়া রহিল। বহুদিন পরে প্রথম মিলনে বালকের ক্ষুদ্র হৃদয়ের মধ্যে যেন একপ্রকার অস্ফুট অভিমান ও লজ্জার উদয় হইল। রাজাকে জড়াইয়া মুখ লুকাইয়া রহিল।
রাজা বলিলেন, “আর সব হইল, কেবল নক্ষত্র আমাকে ভাই বলিল না।” সুজা তীব্রভাবে কহিলেন, “মহারাজ, আর সকলেই অতি সহজেই ভাইয়ের মতো ব্যবহার করে, কেবল নিজের ভাই করে না।” সুজার হৃদয় হইতে এখনো শেল উৎপাটিত হয় নাই।
রাজর্ষি – ৪৫ উপসংহার
এইখানে বলা আবশ্যক তিনটি বালক সুজার তিন ছদ্মবেশী কন্যা। সুজা মক্কা যাইবার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গুরুতর বর্ষার প্রাদুর্ভাবে একখানিও জাহাজ পাইলেন না। অবশেষে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবার পথে, গোবিন্দমাণিক্যের সহিত দুর্গে দেখা হয়। কিছুদিন দুর্গে বাস করিয়া সুজা সংবাদ পাইলেন এখনো সম্রাট-সৈন্য তাঁহাকে সন্ধান করিতেছে। গোবিন্দমাণিক্য যানাদি ও বিস্তর অনুচর-সমেত তাঁহার বন্ধু আরাকান-পতির নিকটে তাঁহাকে প্রেরণ করেন। যাইবার সময় সুজা তাঁহাকে বহুমূল্য তরবারি উপহারস্বরূপ দান করেন।
ইতিমধ্যে রাজা রঘুপতি ও বিলবনে মিলিয়া সমস্ত গ্রামকে যেন সচেতন করিয়া তুলিলেন। রাজার দুর্গ সমস্ত গ্রামের প্রাণ হইয়া উঠিল।
এইরূপে ছয় বৎসর কাটিয়া গেলে ছত্রমাণিক্যের মৃত্যু হইল। গোবিন্দমাণিক্যকে সিংহাসনে ফিরাইয়া লইবার জন্য ত্রিপুরা হইতে দূত আসিল।
গোবিন্দমাণিক্য প্রথমে বলিলেন, “আমি রাজ্যে ফিরিব না।”
বিল্বন কহিলেন, “সে হইবে না মহারাজ। ধর্ম যখন স্বয়ং দ্বারে আসিয়া আহ্বান করিতেছেন তখন তাঁহাকে অবহেলা করিবেন না।”
রাজা তাঁহার ছাত্রদের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আমার এতদিনকার আশা অসমাপ্ত, এতদিনকার কার্য অসম্পূর্ণ রহিবে?”
বিল্বন কহিলেন, “এখানে তোমার কার্য আমি করিব।”
রাজা কহিলেন, “তুমি যদি এখানে থাক তাহা হইলে আমার সেখানকার কার্য অসম্পূর্ণ হইবে।”
বিল্বন কহিলেন, “না মহারাজ, এখন আমাকে আর তোমার আবশ্যক নাই। তুমি এখন আপনার প্রতি আপনি সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে পার। আমি যদি সময় পাই তো মাঝে মাঝে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইব।”
রাজা ধ্রুবকে সঙ্গে লইয়া রাজ্যে প্রবেশ করিলেন। ধ্রুব এখন আর নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। সে বিলবনের প্রসাদে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিয়া শাস্ত্র-অধ্যয়নে মন দিয়াছে। রঘুপতি পুনর্বার পৌরহিত্য গ্রহণ করিলেন। এবার মন্দিরে আসিয়া যেন মৃত জয়সিংহকে পুনর্বার জীবিতভাবে প্রাপ্ত হইলেন।
এ দিকে বিশ্বাসঘাতক আরাকান-পতি সুজাকে হত্যা করিয়া তাঁহার সর্বকনিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করেন।-
“দুর্ভাগা সুজার প্রতি আরাকান-পতির নৃশংসতা সমরণ করিয়া গোবিন্দমাণিক্য দুঃখ করিতেন। সুজার নাম চিরসমরণীয় করিবার জন্য তিনি তরবারের বিনিময়ে বহুতর অর্থদ্বারা কুমিল্লা-নগরীতে একটি উৎকৃষ্ট মসজিদ প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। তাহা অদ্যাপি সুজা-মসজিদ বলিয়া বর্তমান আছে।
“গোবিন্দমাণিক্যের যত্নে মেহেরকুল আবাদ হইয়াছিল। তিনি ব্রাহ্মণগণকে বিস্তর ভূমি তাম্রপত্রে সনন্দ লিখিয়া দান করেন। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কুমিল্লার দক্ষিণে বাতিসা গ্রামে একটি দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন। তিনি অনেক সৎকার্যের অনুষ্ঠান করিতেছিলেন, কিন্তু সম্পন্ন করিতে পারেন নাই। এইজন্য অনুতাপ করিয়া ১৬৬৯ খৃঃ অব্দে মানবলীলা সম্বরণ করেন।”