বিপ্রদাস তার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে, “তোমার শরীর ভালোই দেখছি।”
“বিশেষ ভালো যে তা বলতে পারি নে– সন্ধের দিকটা মাথা ধরে, আর খিদেও ভালো হয় না। খাওয়াদাওয়ার অল্প একটু অযত্ন হলেই সইতে পারি নে। আবার অনিদ্রাতেও মাঝে মাঝে ভুগি, ঐটেতে সব চেয়ে দুঃখ দেয়।”
শুশ্রূষার লোকের যে সর্বদা দরকার তারই ভূমিকা পাওয়া গেল।
বিপ্রদাস বললে, “বোধ করি আপিসের কাজ নিয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে।”
“এমনিই কী! আপিসের কাজকর্ম আপনিই চলে যাচ্ছে, আমাকে বড়ো কিছু দেখতে হয় না। ম্যাক্নটন্ সাহেবের উপরেই বেশির ভাগ কাজের ভার, সার আর্থর পীবডিও আমাকে অনেকটা সাহায্য করেন।”
গুড়গুড়ি এল, পানের বাটায় পান ও মসলা নিয়ে চাকর এসে দাঁড়াল, তার থেকে একটি ছোটো এলাচ নিয়ে মুখে পুরল, আর কিছু নিলে না। গুড়গুড়ির নল নিয়ে দুই-একবার মৃদু মৃদু টান দিলে। তার পরে গুড়গুড়ির নলটা বাঁ হাতে কোলের উপরেই ধরা রইল। আর তার ব্যবহার হল না। অন্তঃপুর থেকে খবর এল জলখাবার প্রস্তুত। ব্যস্ত হয়ে বললে, “ঐটি তো পারব না। আগেই তো বলেছি, খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে খুব ধরকাট করেই চলতে হয়।”
বিপ্রদাস দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলে না। চাকরকে বললে, “পিসিমাকে বলো গে, ওঁর শরীর ভালো নেই, খেতে পারবেন না।”
বিপ্রদাস চুপ করে রইল। মধুসূদন আশা করেছিল, কুমুর কথা আপনিই উঠবে। এতদিন হয়ে গেল,এখন কুমুকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার প্রস্তাব বিপ্রদাস আপনিই উদ্বিগ্ন হয়ে করবে– কিন্তু কুমুর নামও করে না যে! ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে রাগ জন্মাতে লাগল। ভাবলে এসে ভুল করেছি। সমস্ত নবীনের কাণ্ড। এখনই গিয়ে তাকে খুব একটা কড়া শাস্তি দেবার জন্যে মনটা ছট্ফট্ করতে লাগল।
এমন সময় সাদাসিধে সরু কালাপেড়ে একখানি শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা টেনে কুমু ঘরে প্রবেশ করলে। বিপ্রদাস এটা আশা করে নি। সে আশ্চর্য হয়ে গেল। প্রথমে স্বামীর, পরে দাদার পায়ের ধুলো নিয়ে কুমু মধুসূদনকে বললে, “দাদার শরীর ক্লান্ত, ওঁকে বেশি কথা কওয়াতে ডাক্তারের মানা। তুমি এই পাশের ঘরে এসো।”
মধসূদনের মুখ লাল হয়ে উঠল। দ্রুত চৌকি থেকে উঠে পড়ল। কোল থেকে গুড়গুড়ির নলটা মাটিতে পড়ে গেল। বিপ্রদাসের মুখের দিকে না চেয়েই বললে “আচ্ছা, তবে আসি।”
প্রথম ঝোঁকটা হল হন্ হন্ করে গাড়িতে উঠে বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু মন পড়েছে বাঁধা। অনেক দিন পরে আজ কুমুকে দেখেছে। ওকে অত্যন্ত সাদাসিধে আটপৌরে কাপড়ে এই প্রথম দেখলে। ওকে এত সুন্দর আর কখনো দেখে নি। এমন সংযত এত সহজ। মধুসূদনের বাড়িতে ও ছিল পোশাকি মেয়ে, যেন বাইরের মেয়ে, এখানে সে একেবারে ঘরের মেয়ে। আজ যেন ওকে অত্যন্ত কাছের থেকে দেখা গেল। কী স্নিগ্ধ মূর্তি! মধুসূদনের ইচ্ছে করতে লাগল, একটু দেরি না করে এখনই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। ও আমার, ও আমারই, ও আমার ঘরের, আমার ঐশ্বর্যের, আমার সমস্ত দেহমনের, এই কথাটা উলটেপালটে বলতে ইচ্ছে করে।
পাশের ঘরে একটা সোফা দেখিয়ে কুমু যখন বসতে বললে, তখন ওকে বসতেই হল। নিতান্ত যদি বাইরের ঘর না হত তা হলে কুমুকে ধরে সোফায় আপনার পাশে বসাত। কুমু না বসে একটা চৌকির পিছনে তার পিঠের উপর হাত রেখে দাঁড়াল। বললে, “আমাকে কিছু বলতে চাও?”
ঠিক এমন সুরে প্রশ্নটা মধুসূদনের ভালো লাগল না, বললে, “যাবে না বাড়িতে?”
“না।”
মধুসূদন চমকে উঠল– বললে, “সে কী কথা!”
“আমাকে তোমার তো দরকার নেই।”
মধুসূদন বুঝলে শ্যামাসুন্দরীর খবরটা কানে এসেছে, এটা অভিমান। অভিমানটা ভালোই লাগল। বললে, “কী যে বল তার ঠিক নেই। দরকার নেই তো কী? শূন্য ঘর কি ভালো লাগে?”
এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি করতে কুমুর প্রবৃত্তি হল না। সংক্ষেপে আর-একবার বললে, “আমি যাব না।”
“মানে কী? বাড়ির বউ বাড়িতে যাবে না–?”
কুমু সংক্ষেপে বললে, “না।”
মধুসূদন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “কী! যাবে না! যেতেই হবে।”
কুমু কোনো জবাব করলে না। মধুসূদন বললে, “জান পুলিস ডেকে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি ঘাড়ে ধরে? “না’ বললেই হল!”
কুমু চুপ করে রইল। মধুসূদন গর্জন করে বললে, “দাদার স্কুলে নুরনগরি কায়দা শিক্ষা আবার আরম্ভ হয়েছে?”
কুমু দাদার ঘরের দিকে একবার কটাক্ষপাত করে বললে, “চুপ করো, অমন চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না।”
“কেন? তোমার দাদাকে সামলে কথা কইতে হবে নাকি? জান এই মুহূর্তেই ওকে পথে বার করতে পারি?”
পরক্ষণেই কুমু দেখে ওর দাদা ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘকায়, শীর্ণদেহ, পাণ্ডুবর্ণ মুখ, বড়ো বড়ো চোখ দুটো জ্বালাময়, একটা মোটা সাদা চাদর গা ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, কুমুকে ডেকে বললে, “আয় কুমু, আয় আমার ঘরে।”
মধুসূদন চেঁচিয়ে উঠল, বললে, “মনে থাকবে তোমার এই আস্পর্ধা। তোমার নুরনগরের নুর মুড়িয়ে দেব তবে আমার নাম মধূসূদন।”
ঘরে গিয়ে বিপ্রদাস বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করলে, কিন্তু ঘুমে নয়, ক্লান্তিতে ও চিন্তায়। কুমু শিয়রের কাছে বসে পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। এমনি করে অনেকক্ষণ কাটলে পর ক্ষেমাপিসি এসে বললে, “আজ কি খেতে হবে না কুমু? বেলা যে অনেক হল।”
বিপ্রদাস চোখ খুলে বললে, “কুমু, যা খেতে যা। তোর কালুদাকে পাঠিয়ে দে।”
কুমু বললে, “দাদা, তোমার পায়ে পড়ি এখন কালুদাকে না, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো।”