কুমু দাদার পাশে বসে বললে, “দাদা, মাথা ধরেছে কি?”
দাদা বললে, “না।”
“চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যায় নি? তোমার ঘরে লোক দেখে ঢুকতে পারলুম না।”
বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা সব চেয়ে অসহ্য, যখন সে সোনার রথ আনে যার চাকা অচল। দাদার মুখভাবে এই দ্বিধার বেদনা কুমুকে ব্যথা দিলে। দৈবের দানকে কেন দাদা এমন করে সন্দেহ করছেন? বিবাহ-ব্যাপারে নিজের পছন্দ বলে যে একটা উপসর্গ আছে এ চিন্তা কখনো কুমুদিনীর মাথায় আসে নি। শিশুকাল থেকে পরে পরে সে তার চার দিদির বিয়ে দেখেছে। কুলীনের ঘরে বিয়ে– কুল ছাড়া আর বিশেষ কিছু পছন্দর বিষয় ছিল তাও নয়। ছেলেপুলে নিয়ে তবু তারা সংসার করছে, দিন কেটে যাচ্ছে। যখন দুঃখ পায় বিদ্রোহ করে না; মনে ভাবতেও পারে না যে কিছুতেই এটা ছাড়া আর কিছুই হতে পারত। মা কি ছেলে বেছে নেয়? ছেলেকে মেনে নেয়। কুপুত্রও হয় সুপুত্রও হয়। স্বামীও তেমনি। বিধাতা তো দোকান খোলেন নি। ভাগ্যের উপর বিচার চলবে কার?
এতদিন পরে কুমুর মন্দভাগ্যের তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে এল রাজপুত্র ছদ্মবেশে। রথচক্রের শব্দ কুমু তার হৃৎস্পন্দনের মধ্যে ঐ-যে শুনতে পাচ্ছে। বাইরের ছদ্মবেশটা যে যাচাই করে দেখতেই চায় না।
তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই সে পাঁজি খুলে দেখলে, আজ মনোরথ-দ্বিতীয়া। বাড়িতে কর্মচারীদের মধ্যে যে-কয়জন ব্রাহ্মণ আছে সন্ধ্যাবেলা ডাকিয়ে তাদের ফলার করালে, দক্ষিণাও যথাসাধ্য কিছু দিলে। সবাই আশীর্বাদ করলে, রাজরানী হয়ে থাকো, ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হোক।
দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বৈঠকখানায় ঘটকের আগমন। তুড়ি দিয়ে “শিব শিব’ বলে বৃদ্ধ উচ্চস্বরে হাই তুললে। এবারে অসম্মতি দিয়ে কথাটাকে শেষ করে দিতে বিপ্রদাসের সাহস হল না। ভাবলে এতবড়ো দায়িত্ব নিই কী করে? কেমন করে নিশ্চয় জানব কুমুর পক্ষে এ সম্বন্ধ সব চেয়ে ভালো নয়? পরশুদিন শেষ কথা দেবে বলে ঘটককে বিদায় করে দিলে।
যোগাযোগ ১১-১৫
১১
সন্ধ্যার অন্ধকার মেঘের ছায়ায় বৃষ্টির জলে নিবিড়। কুমুর আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। এক পাশে ছোটো খাট, আলনায় গুটি-দুয়েক পাকানো শাড়ি আর চাঁপা-রঙের গামছা। কোণে কাঁঠাল-কাঠের সিন্দুক, তার মধ্যে ওর ব্যবহারের কাপড়। খাটের নীচে সবুজ-রঙ-করা টিনের বাক্সে পান সাজবার সরঞ্জাম, আর-একটা বাক্সে চুল বাঁধবার সামগ্রী। দেয়ালের খাঁজের মধ্যে কাঠের থাকে কিছু বই, দোয়াতকলম, চিঠির কাগজ, মায়ের হাতের পশমে-বোনা বাবার সর্বদা ব্যবহারের চটিজুতোজোড়া; শোবার খাটের শিয়রে রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপের পট। দেয়ালের কোণে ঠেসানো একটা এসরাজ।
ঘরে কুমু আলো জ্বালায় নি। কাঠের সিন্দুকের উপর বসে জানলার বাইরে চেয়ে আছে। সামনে ইঁটের কলেবরওয়ালা কলকাতা আদিম কালের বর্মকঠিন একটা অতিকায় জন্তুর মতো, জলধারার মধ্যে দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার গায়ে গায়ে আলোকশিখার বিন্দু। কুমুর মন তখন ছিল অদৃষ্টনিরূপিত তার ভাবীলোকের মধ্যে। সেখানকার ঘরবাড়ি-লোকজন সবই তার আপন আদর্শে গড়া। তারই মাঝখানে নিজের সতীলক্ষ্মী-রূপের প্রতিষ্ঠা– কত ভক্তি, কত পূজা, কত সেবা! তার নিজের মায়ের পুণ্যচরিতে এক জায়গায় একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। তিনি স্বামীর অপরাধে কিছুকালের জন্যেও ধৈর্য হারিয়েছিলেন। কুমু কখনো সে ভুল করবে না।
বিপ্রদাসের পায়ের শব্দ শুনে কুমু চমকে উঠল। দাদাকে দেখে বললে, “আলো জ্বেলে দেব কি?”
“না কুমু, দরকার নেই” বলে বিপ্রদাস সিন্দুকে তার পাশে এসে বসল। কুমু তাড়াতাড়ি মেজের উপর নেমে বসে আস্তে আস্তে তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
বিপ্রদাস স্নিগ্ধস্বরে বললে, “বৈঠকখানায় লোক এসেছিল, তাই তোকে ডেকে পাঠাই নি। এতক্ষণ একলা বসে ছিলি?”
কুমু লজ্জিত হয়ে বললে, “না, ক্ষেমাপিসি অনেকক্ষণ ছিলেন।” কথাটা ফিরিয়ে দেবার জন্যে বললে, “বৈঠকখানায় কে এসেছিল, দাদা?”
“সেই কথাই তোকে বলতে এসেছি। এ বছর জষ্টি মাসে তুই আঠারো পেরিয়ে উনিশে পড়লি, তাই না?”
“হাঁ দাদা, তাতে দোষ হয়েছে কী?”
“দোষের কথা না। আজ নীলমণি ঘটক এসেছিল। লক্ষ্মী বোন, লজ্জা করিস নে। বাবা যখন ছিলেন, তোর বয়স দশ– বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েছিল। হয়ে গেলে তোর মতের অপেক্ষা কেউ করত না। আজ তো আমি তা পারি নে। রাজা মধুসূদন ঘোষালের নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস। বংশমর্যাদায় ওঁরা খাটো নন। কিন্তু বয়সে তোর সঙ্গে অনেক তফাত। আমি রাজি হতে পারি নি। এখন, তোর মুখের একটা কথা শুনলেই চুকিয়ে দিতে পারি। লজ্জা করিস নে কুমু।”
“না, লজ্জা করব না।” বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। “যাঁর কথা বলছ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ঠিক হয়েই গেছে।” এটা সেই ঘটকের কথার প্রতিধ্বনি– কখন কথাটা এর মনের গভীরতায় আটকা পড়ে গেছে।
বিপ্রদাস আশ্চর্য হয়ে বললে, “কেমন করে ঠিক হল?”
কুমু চুপ করে রইল।
বিপ্রদাস তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, “ছেলেমানুষি করিস নে, কুমু।”
কুমুদিনী বললে, “তুমি বুঝবে না দাদা, একটুও ছেলেমানুষি করছি নে।”
দাদার উপর তার অসীম ভক্তি। কিন্তু দাদা তো দৈববাণী মানে না, কুমুদিনী জানে এইখানেই দাদার দৃষ্টির ক্ষীণতা।
বিপ্রদাস বললে, “তুই তো তাঁকে দেখিস নি।”
“তা হোক, আমি যে ঠিক জেনেছি।”