বিভা আর চোখে কিছু দেখিতে পাইল না, মাথা ঘুরিয়া সেইখানে পড়িয়া গেল। রামমোহন তাড়াতাড়ি জল আনিয়া বিভার মুখে-চোখে ছিটা দিল। কিছুক্ষণ পরে বিভা উঠিয়া বসিল। এক আঘাতে বিভার সমস্ত জগৎ ভাঙিয়া গেছে। স্বামীর রাজ্যের মধ্যে আসিয়া, রাজধানীর কাছে পৌঁছিয়া, রাজপুরীর দুয়ারে আসিয়া তৃষার্তহৃদয় বিভার সমস্ত সুখের আশা মরীচিকার মতো মিলাইয়া গেল।
বিভা আকুলভাবে কহিল, “মোহন, তিনি যে আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন– আমার আসিতে কি বড়ো বিলম্ব হইয়াছে?”
মোহন কহিল, “বিলম্ব হইয়াছে বই কি।”
বিভা অধীর হইয়া কহিল, “আর কি মার্জনা করিবেন না?”
মোহন কহিল, “মার্জনা আর করিলেন কই।”
বিভা কহিল, “মোহন, আমি কেবল একবার তাঁহাকে দেখিতে যাইব।” বলিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে কাঁদিয়া উঠিল।
রামমোহন চোখ মুছিয়া কহিল, “আজ থাক্ না, মা।”
বিভা কহিল, “না মোহন, আমি আজই একবার তাঁহাকে দেখিয়া আসিব।”
রামমোহন কহিল, “যুবরাজ আগে গ্রাম হইতে ফিরিয়া আসুন।”
বিভা কহিল, “না মোহন, এখনই একবার যাই।”
বিভা মনে করিয়াছিল, উদয়াদিত্য এ সংবাদ শুনিলে অপমানের ভয়ে পাছে না যাইতে দেন।
রামমোহন কহিল, “তবে একখানি শিবিকা আনাই।”
বিভা কহিল, “শিবিকা কেন? আমি কি রানী যে শিবিকা চাই। আমি একজন সামান্য প্রজার মতো, একজন ভিখারিনীর মতো যাইব, আমার শিবিকায় কাজ কী?”
রামমোহন কহিল, “আমার প্রাণ থাকিতে আমি তাহা দেখিতে পারিব না।”
বিভা কাতর স্বরে কহিল, “মোহন, তোর পায়ে পড়ি, আমাকে আর বাধা দিস্ নে, বিলম্ব হইয়া যাইতেছে।”
রামমোহন ব্যথিতহৃদয়ে কহিল, “আচ্ছা মা, তাহাই হউক।”
বিভা সামান্য রমণীর বেশে নৌকা হইতে বাহির হইল। নৌকার ভৃত্যেরা আসিয়া কহিল, “এ কী মা, এমন করিয়া এ বেশে কোথায় যাও!”
রামমোহন কহিল, “এ তো মায়ের রাজ্য, যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন।”
ভৃত্যেরা আপত্তি করিতে লাগিল, রামমোহন তাহাদের ভাগাইয়া দিল।
সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ
চারিদিকে লোকজন, চারিদিকেই ভিড়। আগে হইলে বিভা সংকোচে মারিয়া যাইত, আজ কিছুই যেন তাহার চোখে পড়িতেছে না। যাহা কিছু দেখিতেছে সমস্ত যেন বিভার মিথ্যা বলিয়া মনে হইতেছে। চারিদিকে যেন একটা কোলাহলময় স্বপ্নের ঘেঁষাঘেঁষি– কিছুই যেন কিছু নয়। চারিদিকে একটা ভিড় চোখে পড়িতেছে এই পর্যন্ত, চারিদিক হইতে একটা কোলাহল শোনা যাইতেছে এই পর্যন্ত, তাহার যেন একটা কোনো অর্থ নাই।
ভিড়ের মধ্য দিয়া রাজপুরীর দ্বারের নিকট আসিতেই একজন দ্বারী সহসা বিভার হাত ধরিয়া বিভাকে নিবারণ করিল, তখন সহসা বিভা একমুহূর্তে বাহ্য জগতের মধ্যে আসিয়া পড়িল, চারিদিক দেখিতে পাইল, লজ্জায় মরিয়া গেল। তাহার ঘোমটা খুলিয়া গিয়াছিল, তাড়াতাড়ি মাথার ঘোমটা তুলিয়া দিল। রামমোহন আগে আগে যাইতেছিল, সে পশ্চাৎ ফিরিয়া দ্বারীর প্রতি চোখ পাকাইয়া দাঁড়াইল। অদূরে ফর্নাণ্ডিজ ছিল,যে আসিয়া দ্বারীকে ধরিয়া বিলক্ষণ শাসন করিল। বিভা প্রাসাদে প্রবেশ করিল। অন্যান্য দাসদাসীর ন্যায় বিভা প্রাসাদে প্রবেশ করিল, কেহ তাহাকে সমাদর করিল না।
ঘরে কেবল রাজা ও রমাই ভাঁড় বসিয়াছিলেন। বিভা গৃহে প্রবেশ করিয়া রাজার মুখের দিকে চাহিয়াই রাজার পায়ের কাছে ভূমিতে পড়িয়া গেল। রাজা শশব্যস্ত হইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুই? ভিখারিনী? ভিক্ষা চাহিতে আসিয়াছিস?”
বিভা নত মুখ তুলিয়া অশ্রুপূর্ণনেত্রে রাজার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “না মহারাজ, আমার সর্বস্ব দান করিতে আসিয়াছি। আমি তোমাকে পরের হাতে সমর্পণ করিয়া বিদায় লইতে আসিয়াছি।”
রামমোহন থাকিতে পারিল না, কাছে আসিয়া কহিল, “মহারাজ, আপনার মহিষী– যশোহরের রাজকুমারী।”
সহসা রামচন্দ্র রায়ের প্রাণ যেন কেমন চমকিয়া উঠিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ রমাই ভাঁড় হাসিয়া রাজার দিকে কটাক্ষ করিয়া কঠোর কণ্ঠে কহিল, “কেন, এখন কি আর দাদাকে মনে ধরে না নাকি?”
রামচন্দ্র রায়ের হৃদয়ে করুণার আভাস জাগিয়া উঠিয়াছিল, তথাপি রমাইয়ের কথায় তিনি নিষ্ঠুর হাস্য করিয়া উঠিলেন। তিনি ভাবিলেন, বিভাকে এখন মমতা দেখাইলে পাছে উপহাসাস্পদ হইতে হয়।
বিভার মাথায় একেবারে সহস্র বজ্রাঘাত হইল, সে লজ্জায় একেবারে মরিয়া গেল। চোখ বুজিয়া মনে মনে কহিল, মা গো, বসুন্ধরা, তুমি দ্বিধা হও। কাতর হইয়া চারিদিকে চাহিল, রামমোহনের মুখের দিকে একবার অসহায় দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিল।
রামমোহন ছুটিয়া আসিয়া সবলে রমাই ভাঁড়ের ঘাড় টিপিয়া ধরিয়া তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল।
রাজা ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “রামমোহন, তুই আমার সম্মুখে বেয়াদবি করিস!”
রামমোহন কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, “মহারাজ, আমি বেয়াদবি করিলাম। তোমার মহিষীকে– আমার মা-ঠাকরুনকে বেটা অপমান করিল– উহার হইয়াছে কী, আমি উহার মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া শহর হইতে বাহির করিয়া দিব, তবে আমার নাম রামমোহন।”
রাজা রামমোহনকে ধমক দিয়া কহিলেন, “কে আমার মহিষী? আমি উহাকে চিনি না।”
বিভার মুখ নীল হইয়া গেল, সে মুখে আঁচল চাপিয়া ধরিল, থর থর করিয়া তাহার সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল, অবশেষে কাঁপিতে কাঁপিতে বিভা মূর্ছিতা হইয়া ভূমিতে পড়িল। তখন রামমোহন জোড়হস্তে রাজাকে কহিল, “মহারাজ, আজ চারপুরুষে তোমার বংশে আমরা চাকরি করিয়া আসিতেছি। বাল্যকাল হইতে তোমাকে পালন করিয়াছি। আজ তুমি আমার মা-ঠাকরুনকে অপমান করিলে, তোমার রাজ্যলক্ষ্মীকে দূর করিয়া দিলে, আজ আমিও তোমার চাকরি ছাড়িয়া দিয়া চলিলাম। আমার মা-ঠাকরুনের সেবা করিয়া জীবন কাটাইব। ভিক্ষা করিয়া খাইব, তবুও এ রাজবাটীর ছায়া মাড়াইব না।” বলিয়া রামমোহন রাজাকে প্রণাম করিল ও বিভাকে কহিল, “আয় মা, আয়। এখান হইতে শীঘ্র চলিয়া আয়। আর একমুহূর্তও এখানে থাকা নয়।” বলিয়া বিভাকে ধরিয়া তুলিয়া আনিল। দ্বারের নিকট অনেকগুলি শিবিকা ছিল, তাহার মধ্যে একটিতে হতজ্ঞান অবসন্ন বিভাকে তুলিয়া নৌকায় ফিরিয়া আসিল।