অক্ষয় কহিলেন, “আরে মশায়, নাম শুনেই হাসি! তা হলে তো গন্ধে অজ্ঞান এবং পাতে পড়লে মারাই যাবেন! তা, যেটা হয় মন স্থির করে বলুন– মুর্গি হবে না মটন হবে?”
তখন দুজনে বুঝিল, আহারের কথা হইতেছে। ভীরু মৃত্যুঞ্জয় নিরুত্তর হইয়া ভাবিতে লাগিল। দারুকেশ্বর লালায়িত রসনায় এক বার চারি দিকে চাহিয়া দেখিল।
অক্ষয় কহিলেন, “ভয় কিসের মশায়? নাচতে বসে ঘোমটা?”
শুনিয়া দারুকেশ্বর দুই হাতে দুই পা চাপড়াইয়া হাসিতে লাগিল। কহিল, তা, “মুর্গিই ভালো, কটলেট! কী বলেন?”
লুব্ধ মৃত্যুঞ্জয় সাহস পাইয়া বলিল, “মটনটাই বা মন্দ কী ভাই! চপ–”
বলিয়া আর কথাটা শেষ করিতে পারিল না।
অক্ষয়। ভয় কী দাদা, দু-ই হবে! দোমনা করে খেয়ে সুখ হয় না।
চাকরকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওরে, মোড়ের মাথায় যে হোটেল আছে সেখান থেকে কলিমদ্দি খানসামাকে ডেনে আন্ দেখি।”
তাহার পর অক্ষয় বুড়ো আঙুল দিয়া মৃত্যুঞ্জয়ের গা টিপিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “বিয়ার না শেরি?”
মৃত্যুঞ্জয় লজ্জিত হইয়া মুখ বাঁকাইল। দারুকেশ্বর সঙ্গীটিকে বদরসিক বলিয়া মনে মনে গালি দিয়া কহিল, “হুইস্কির বন্দোবস্ত নেই বুঝি?”
অক্ষয় তাহার পিঠ চাপড়াইয়া কহিলেন, “নেই তো কী? বেঁচে আছি কী করে?”
বলিয়া যাত্রার সুরে গাহিয়া উঠিলেন–
অভয় দাও তো বলি আমার wish কী,
একটি ছটাক সোডার জলে পাকি তিন পোয়া হুইস্কি!
ক্ষীণপ্রকৃতি মৃত্যুঞ্জয়ও প্রাণপণে হাস্য করা কর্তব্য বোধ করিল এবং দারুকেশ্বর ফস করিয়া একটা বই টানিয়া লইয়া টপাটপ বাজাইতে আরম্ভ করিল।
অক্ষয় দু-লাইন গাহিয়া থামিবামাত্র দারুকেশ্বর বলিল, “দাদা, ওটা শেষ করে ফেলো!” বলিয়া নিজেই ধরিল, “অভয় দাও তো বলি আমার wish কী।” মৃত্যুঞ্জয় মনে মনে তাহাকে বাহাদুরি দিতে লাগিল।
অক্ষয় মৃত্যুঞ্জয়কে ঠেলা দিয়া কহিলেন, “ধরো না হে, তুমিও ধরো!”
সলজ্জ মৃত্যুঞ্জয় নিজের প্রতিপত্তি রক্ষার জন্য মৃদুস্বরে যোগ দিল– অক্ষয় ডেস্ক চাপড়াইয়া বাজাইতে লাগিলেন। এক জায়গায় হঠাৎ থামিয়া গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “হাঁ, হাঁ, আসল কথাটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি। এ দিকে তো সব ঠিক– এখন আপনারা কী হলে রাজি হন?”
দারুকেশ্বর কহিল, “আমাদের বিলেতে পাঠাতে হবে।”
অক্ষয় কহিলেন, “সে তো হবেই। তার না কাটলে কি শ্যাম্পেনের ছিপি খোলে? দেশে আপনাদের মতো লোকের বিদ্যেবুদ্ধি চাপা থাকে, বাঁধন কাটলেই একেবারে নাকে মুখে চোখে উছলে উঠবে।”
দারুকেশ্বর অত্যন্ত খুশি হইয়া অক্ষয়ের হাত চাপিয়া ধরিল, কহিল, “দাদা, এইটে তোমাকে করে দিতেই হচ্ছে। বুঝলে?”
অক্ষয় কহিলেন, “সে কিছুই শক্ত নয়। কিন্তু ব্যাপ্টাইজ আজই তো হবেন?”
দারুকেশ্বর ভাবিল, ঠাট্টাটা বোঝা যাইতেছে না। হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “সেটা কিরকম?”
অক্ষয় কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের ভাবে কহিলেন, “কেন, কথাই তো আছে, রেভারেণ্ড্ বিশ্বাস আজ রাত্রেই আসছেন। ব্যাপ্টিজ্ম্ না হলে তো ক্রিশ্চান মতে বিবাহ হতে পারে না!”
মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত ভীত হইয়া কহিল, “ক্রিশ্চান মতে কী মশায়?”
অক্ষয় কহিলেন, “আপনি যে আকাশ থেকে পড়লেন! সে হচ্ছে না– ব্যাপ্টাইজ যেমন করে হোক, আজ রাত্রেই সারতে হচ্ছে। কিছুতেই ছাড়ব না।”
মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা ক্রিশ্চান না কি?”
অক্ষয়। মশায়, ন্যাকামি রাখুন। যেন কিছুই জানেন না।
মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত ভীতভাবে কহিল, “মশায়, আমরা হিঁদু, ব্রাহ্মণের ছেলে, জাত খোওয়াতে পারব না।”
অক্ষয় হঠাৎ অত্যন্ত উদ্ধতস্বরে কহিলেন, “জাত কিসের মশায়! এ দিকে কলিমদ্দির হাতে মুর্গি খাবেন, বিলেত যাবেন, আবার জাত!”
মৃত্যুঞ্জয় ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিল, “চুপ, চুপ, চুপ করুন! কে কোথা থেকে শুনতে পাবে।”
তখন দারুকেশ্বর কহিল, “ব্যস্ত হবেন না মশায়, একটু পরামর্শ করে দেখি!”
বলিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে একটু অন্তরালে ডাকিয়া লইয়া বলিল, “বিলেত থেকে ফিরে সেই তো একবার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে– তখন ডবল প্রায়শ্চিত্ত করে একেবারে ধর্মে ওঠা যাবে। এ সুযোগটা ছাড়লে আর বিলেত যাওয়াটা ঘটে উঠবে না। দেখলি তো কোনো শ্বশুরই রাজি হল না। আর ভাই, ক্রিশ্চানের হুঁকোয় তামাকই যখন খেলুম তখন ক্রিশ্চান হতে আর বাকি কী রইল?” এই বলিয়া অক্ষয়ের কাছে আসিয়া কহিল, “বিলেত যাওয়াটা তো নিশ্চয় পাকা? তা হলে ক্রিশ্চান হতে রাজি আছি।”
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “কিন্তু আজ রাতটা থাক্।”
দারুকেশ্বর কহিল, “হতে হয় তো চট্পট্ সেরে ফেলে পাড়ি দেওয়াই ভালো– গোড়াতেই বলেছি, শুভস্য শীঘ্রং।”
ইতিমধ্যে অন্তরালে রমণীগণের সমাগম। দুই থালা ফল মিষ্টান্ন লুচি ও বরফ-জল লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ। ক্ষুণ্ন দারুকেশ্বর কহিল, “কই মশায়, অভাগার অদৃষ্টে মুর্গি বেটা উড়েই গেল নাকি? কট্লেট কোথায়?”
অক্ষয় মৃদুস্বরে বলিলেন, “আজকের মতো এইটেই চলুক।”
দারুকেশ্বর কহিল, “সে কি হয় মশায়! আশা দিয়ে নৈরাশ! শ্বশুরবাড়ি এসে মটন চপ খেতে পাব না? আর এ যে বরফ-জল মশায়, আমার আবার সর্দির ধাত, সাদা জল সহ্য হয় না।” বলিয়া গান জুড়িয়া দিল, “অভয় দাও তো বলি আমার wish কী” ইত্যাদি। অক্ষয় মৃত্যুঞ্জয়কে কেবলই টিপিতে লাগিলেন এবং অস্পষ্ট স্বরে কহিতে লাগিলেন, “ধরো না হে, তুমিও ধরো না– চুপচাপ কেন।” সে ব্যক্তি কতক ভয়ে কতক লজ্জায় মৃদু মৃদু যোগ দিতে লাগিল। গানের উচ্ছ্বাস থামিলে অক্ষয় আহারপাত্র দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নিতান্তই কি এটা চলবে না?”